পাথরের দেওয়াল চলে গিয়েছে যেন হাজার মাইল ধরে। নভেম্বরের ঝকঝকে আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য। ইউরোপে ঠাণ্ডা জমিয়ে বসছে আস্তে আস্তে। পাথুরে দেওয়ালের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। তার দুই ধারে গাছ আগুন রাঙা। তারও পরে দূর্গের বাইরের শহরের বাড়ির টালির রঙ ও লাল, সারিবদ্ধ চলে গিয়েছে দিগন্ত অবধি। তার পরে বিস্তীর্ণ ভূমি মনুষ্য বসতি হীন। তারও পরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। হঠাৎ মনে হলো দূর থেকে বুঝি এগিয়ে আসছে কোনো অশ্বারোহী, কানে যেন ভেসে আসে গ্ল্যাডিয়েটরের বিখ্যাত গানের সুর ‘নাউ উই আর ফ্রি।‘ দূর কোন যুদ্ধভূমি থেকে ফিরে আসছে কোন স্প্যানিয়ার্ড তার স্বভূমির সন্ধানে।
মাদ্রিদ গিয়েছিলাম কোর্স করতে কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে যার শুধু পড়াশুনা করে কি তার মন ভরে! তাই বেরিয়ে পরা অজানাকে উদ্দেশ্য করে। ট্রেনে চেপে সন্ত আর পাথরের শহর আভিলা। সময় লাগে দেড় ঘণ্টা মত। আমি পৌঁছেছিলাম রাত্রে তাই ষ্টেশন থেকে ক্যাব নিয়েছিলাম দূর্গ শহরটির ভিতরে ঢুকতে। আমার রাত্রির আস্তানা সেইখানেই। এ শহরে আসার আমার প্রথম কারণ এই দূর্গের ভিতর থাকতে কেমন লাগে সেটা অনুভব করা।
আভিলার অন্যতম আকর্ষণ পুরোনো শহরের চতুর্বিদিকের বিরাট দেওয়াল আর ভিতরের অসংখ্য চার্চ আর ধর্মীয় স্থান। বিরাট মধ্যযূগীয় দেওয়ালের ভিতরে পুরোনো শহর এবং ধর্মস্থান গুলি। পর্যটককুল প্রধানত এইখানেই থাকে। বাইরে আধুনিক শহর। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা থাকে। এ শহরের পর্যটন প্রধানত ধর্মীয়, জায়গাটি খ্রিষ্টান ক্যাথলিক ধর্মের খুব নাম করা তীর্থ। স্পেনের এক জায়গায় সব থেকে বেশী চার্চ একসাথে আছে এই ছোট্ট শহরটিতে। সন্ধ্যায় খাবার জন্য প্রচুর রেস্তোরাঁ আছে দূর্গের দেওয়ালের ভিতরে। যতদূর মনে পড়ে ভারতীয় আর চাইনিজ রেস্টুরেন্টও দেখেছিলাম তাদের মাঝে। তা ছাড়া আছে কিছু জামা কাপড়ের দোকান, সব ডিজাইনার আর কিছু গিফ্ট শপ। রাত্রিবেলায় দূর্গের দেওয়াল আলোকিত হয়ে ওঠে আর বহুদূর থেকে দেখা যায়। ভৌগোলিক ভাবে শহরটি আদাজা নদীর তীরে একটি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত যার উচ্চতা ৩৭১৪ ফিট। ইংরেজিতে যাকে টেবল টপ বলে পাহাড়ের মাথাটি তাই এবং সম্পূর্ণ ভাবে সবুজ বিহীন বাদামী ধূসর ভূমি। আবহাওয়া মোটামুটি ভূমধ্য সাগরীয়। তাপমাত্রা গরমে ১৮-২০ আর শীত কালে ২-৩। শীতে বরফ পরে এবং বৃষ্টি সারা বছরই খুব একটা হয়না। আদাজা নদীতে গরমের সময় জল থাকেনা, আমি যখন গিয়েছি নদী তখনও একেবারে শুকনো ছিল।
ষোড়শ শতাব্দীতে নতুন করে তৈরী ১০০০ বছরের পুরানো দূর্গ শহর যেন ইতিহাসের পাতা থেকে তোলা, সময় এখানে থমকে আছে। শহরের ভিতর অবাধে হেঁটে বেড়ানো যায়। মোটর গাড়ির দৌরাত্ম নেই বললেই চলে। রাতের রাস্তায় একা একা হাঁটছি আর মনে হচ্ছে যেন মোড় ঘুরতেই দেখা হবে কোনো এক অশ্বারোহী নাইটের সাথে। পাশ দিয়ে হয়তো এক্ষুণি চলে যাবে একদল নান। ভাবনার সাথে মিলিয়ে পাথরের রাস্তা আর প্রতি ১৫ মিনিটে গীর্জার ঘন্টা। হোটেলের ভিতর অবশ্য যৎপরোনাস্তি আধুনিক। শহর অত্যন্ত নিরাপদ তবে ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। মধ্যরাত্রির পরে কিছু খোলা থাকতে দেখিনি।
আভিলা প্রথম তৈরী হয়েছিলো খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। আইবেরিয়ান মালভূমিতে এক জাতির লোক থাকতো যাদের নাম ভেটোনস, এরা কেলটিকদের বংশধর। এদের ভাষায় ওবিলা কথাটির মানে ছিলো উঁচু পাহাড়। এরাই এই জায়গার প্রথম নামকরণ করে এবং এখানে একটি দূর্গ তৈরী করে। এই সময়ের কিছু নিদর্শন এখনও দেখা যায় এখানে। আজকের শহরটি প্রথম তৈরী হয় রোমানদের হাতে। শহরের প্ল্যান রোমানদের মত। চতুষ্কোণ শহর, মাঝে দুটি রাস্তা যা নিজেদেরকে ক্রস করেছে ঠিক মধ্যিখানে। শহরের জায়গায় জায়গায় রোমান উপস্থিতি এখনও বিদ্যমান। খৃষ্টধর্মের প্রচার শুরু হয় যখন, তখন এ শহর রোমানদের থেকে হাত বদল করে একটি জার্মান গোষ্ঠীর দখলে। ফলে উত্তর আইবেরিয়া থেকে বারবার আক্রমণ করলেও শহর থেকে যায় অজেয়। শহর ফাঁকা হতে থাকে ক্রমশ এবং এক সময় প্রায় জনমানুষহীন হয়ে পড়ে জায়গাটি। ১০৮৮ সালে লিয়নের রাজার হাতে আবার শুরু হয় মানুষের আগমন এবং বর্তমান বিখ্যাত দেওয়ালটি তারই নির্দেশে তৈরী। শহর বর্ধিষ্ণু হতে থাকে, গীর্জা তৈরী হয়, দেওয়াল তৈরী হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে বাড় বাড়ন্ত হয় যা চলে প্রায় একশ বছর। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ক্রমশ আধুনিক সমাজের অজ্ঞাতে চলে যেতে থাকে আভিলা। ১৯৮৫ সালে আভিলা চিণ্হিত হয় ইউনেস্কোর ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট হিসেবে।
সকালবেলায় ঘুম ভাঙলো মনোরম শীতের ঝকঝকে আকাশ আর সূর্যের মুখ দেখে। অভ্যাস মত হোটেলেই ব্রেকফাষ্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।
অলিগলি বেয়ে অজস্র গীর্জার মাঝে দেখতে থাকি বিশেষ কিছু। এর মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল অফ আভিলা। কিছুটা দূর্গ কিছুটা গীর্জা কিছুটা দেওয়ালের অংশ: এখানে রাজা আলোনসোর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।
ক্যাথিড্রাল ডি আভিলা
আমি যখন গিয়েছি তখন রবিবারের প্রার্থনার আয়োজন চলছে। পশ্চিম ইউরোপের গীর্জাগুলিতে এমনিতে ছবি তোলা যায় এবং প্রার্থনার সময় বসে থাকা যায়। এখানে দেখলাম আলাদা ঘরে হচ্ছে, প্রধান চ্যাপেলের বাইরে। গীর্জাটি বিভিন্ন শতাব্দীর স্থাপত্যের নিদর্শন বুকে করে টিকে আছে কালের প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে। নানা রঙের পাথর দিয়ে তৈরী এর দেওয়াল গীর্জার ভিতরে এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য আনে যা আমি ইউরোপের খুব কম গীর্জাতে দেখেছি।
ক্যাথিড্রাল ডি আভিলা
আভিলার খৃষ্টীয় ইতিহাস সম্পূর্ণ হয়না সেন্ট টেরেসার কথা না বললে। উচ্চবিত্ত ঘরে জন্মানো টেরেসার পরিবার ছিল ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক খৃষ্টিয়ান। ১৫১৫ সালে জন্মানো এই সময়ের আগে চলা মহিলা প্রথমে গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। বাড়ির লোকেরা আভিলার দেওয়ালের বাইরে থেকে ধরে নিয়ে আসে। তখন উচ্চবিত্ত লোকেরা থাকতো দেওয়ালের ভিতরে আর সাধারণ কাজের লোকেরা থাকতো দেওয়ালের বাইরে। যাই হোক টেরেসা কার্মেলাইট অর্ডার এ যোগ দেন এবং সেইখান থেকে শুরু হয় তার ধর্মীয় যাত্রা। একটা সময় তিনি ঘোষণা করেন খৃষ্টকে তিনি অনুভব করতে পারছেন আর পাঁচটা মানুষের মত। বিতর্ক ঘিরে ওঠে, দূর দুরান্ত থেকে মানুষ তাকে দেখতে আসতে শুরু করেন আর গীর্জার সাধনা পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। এর পরে শুরু হয় তার সঙ্গে খৃষ্টধর্মের মাথাদের এক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঘৃণা আর অবিশ্বাস মিশ্রিত এক অদ্ভুত সম্পর্ক। কথিত আছে তিনি নাকি শূন্যে ভাসতে পারতেন এবং তার সঙ্গী একদল নানের কাজ ছিল তাকে মাটিতে নামিয়ে আনা। পরবর্তীকালে ডাক্তারদের গবেষণায়ও মনে করা হয়েছে এক ধরনের মৃগীরোগ তার এইসব ঘটনার জন্য দায়ী। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা সে বিতর্কে না গিয়ে বলি, তার নিজের সময়ে তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা মহিলারা সে সময় ভাবতে পারতেন না- যেমন পড়ানো। যাইহোক এক সময় তার নিজের কনভেন্ট তৈরী হয় এবং সেখানেই তিনি শেষ জীবন কাটান। মৃত্যু পরবর্তীতে তার খ্যাতি আরও দেশে দেশে প্রচারিত হয় এবং এক সময় তার কফিন পুনোরোত্থিত করে দেহের বিভিন্ন অংশ বিশ্বের বড় বড় গীর্জাতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোমে বার্নিনির এক বিখ্যাত চিত্র আছে ওনার আর খৃষ্টের সম্পর্ক দেখিয়ে।
কনভেন্ট অফ সেন্ট তেরেসা ডি যীসাস
সেন্ট টেরেসার কনভেন্ট দেখে অল্প কিছু খেয়ে তৈরী হলাম বিখ্যাত দেওয়ালটি প্রদক্ষিণ করবো বলে। অনেক রাস্তা, ১১০০-১৪০০ শতাব্দী মিলিয়ে তৈরী দেওয়ালটি ২৫১৬ মি লম্বা (পরিধি), ভিতরের অংশ চৌকো এবং ৮৮ টি স্তম্ভ আছে। অধিকাংশ যায়গায় উচ্চতা ১২মি, স্তম্ভ গুলি ২০মি মত। বিখ্যাত গেট সেন্ট ভিনসেন্টের আর আলকাজারের। সব মিলিয়ে ৯টি গেট আছে।
প্রাচীরের সর্বোচ্চ অংশ
স্প্যানিশ শীতের মনোরম দিনে হাঁটতে বেশ লাগে, চোখ চলে যায় দূর থেকে দূরে। কোনো জায়গায় দেওয়াল ঢুকে গিয়েছে বাড়ি বা গীর্জার ভিতরে আবার কোথাও সে বড় নি:সঙ্গ। দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। দিনান্ত বেলায় রোদ পরে আসে, বাড়তে থাকে শীত। আমারও সময় হয়ে আসে শহর ছাড়ার। যেতে হবে আরও এক স্বল্প চেনা শহর সেগোভিয়াতে।
কিছু কাজের কথা:
মাদ্রিদ থেকে ১-২ দিনের জন্য ভালো ট্রিপ। শীতকালে গেলে দেওয়ালের আলো দেখতে পাওয়া যায়। এটি বিশ্বের সর্ব বৃহৎ আলোকিত মনুমেন্ট।
দেওয়ালের উপর দিয়ে হেঁটে পুরোটা দেখতে গেলে কিছুটা শারীরিক সামর্থ্য লাগে। তবে ইচ্ছে করলে মাঝে নেমে পড়া যায়।
হোটেল ভাড়া : ভারতীয় মুদ্রায় রাতপিছু ৫০০০-১৫০০০ টাকা (২ জন থাকার মত ঘর- নিজস্ব বাথরুম সহ)।
খাবারের জায়গা আছে বেশ কিছু তবে উইকএন্ডে খুব ভিড় হয় বসে খেতে গেলে। সব থেকে ভালো সকাল বেলায় বড় প্রাতরাশ এবং রাত্রে বড় ডিনার।
সাব ভিন্সেন্ট ডি আভিলা