গল্পটা এভাবেও শুরু হতে পারতো। একটা সুড়ঙ্গ, বিয়ারের মগ আর উত্তর কলকাতা। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের এবারের সপ্তাহান্তিক বেড়ানোর চুম্বকসার কিন্তু এই তিনটিই। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আসার পর থেকে টিনটিনের দেশ বেলজিয়ামে যাওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিলই। শুধু তো টিনটিন নয়, বেলজিয়াম মানে অড্রে হেপবার্ন, বেলজিয়াম মানে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ফুল ফোটানো এনজো শিফো। যাই হোক, সময়সীমা ফুরিয়ে আসা শেনজেন ভিসার সদ্ব্যবহারে আমরা ঠিক করলাম সপ্তাহান্তে পাড়ি দেবো বেলজিয়ামের ব্রুজ, বেলজিয়ানরা যাকে আদর করে ডাকে ভেনিস অফ দ্য নর্থ। একটা আস্ত শহর পুরোটাই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, যে শহরের প্রতিটা গলি, প্রতিটা মোড় কোনও না কোনও গল্প বলে, এহেন ব্রুজ হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকবেনা তা কি হয়! সর্বোপরি ব্রুজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা চুলের বিনুনির ন্যায় ক্যানাল গুচ্ছ। ব্রুজের ক্যানালগুচ্ছর পোশাকি নাম হল রেই। আমরা ঠিক করলাম লন্ডন থেকে বাসে করেই ব্রুজ যাবো। তার একটা কারণ ছিল লন্ডন সিটি সেন্টার থেকে ব্রুজ সিটি সেন্টার অবধি সরাসরি চলে যাওয়া (লন্ডন শহর থেকে লন্ডনের যেকোনো এয়ারপোর্ট যাওয়াটাই একটা ছোটখাটো ভ্রমণ বিশেষ) আর দ্বিতীয় কারণ ছিল বাসে করে ইংলিশ চ্যানেল পেরনোর অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ করা। যাইহোক লন্ডন ভিক্টোরিয়া কোচ ষ্টেশন থেকে ব্রুজ গামী বাসে উঠে বসলাম আমি আর আমার সহধর্মিণী সাথে আমাদের পুত্র লিও। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বাস পৌঁছে গেলো ডোভার অর্থাৎ ইংলিশ চ্যানেলের কিনারায়। এখানে ইমিগ্রেশন হয়ে যাওয়ার পরে আস্ত বাসটা দিব্যি হেলতে দুলতে ডোভার ট্রেন ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নেমে একটা ট্রেনের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
সেই ট্রেনই নাকি ইংলিশ চ্যানেলের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আমাদের ফ্রান্সে পৌঁছে দেবে। ট্রেনের ভিতর শুধু বাস নয়, প্রচুর ছোট বড় গাড়ি মায় আস্ত লরি অবধি আছে। এহেন অশৈলী কাণ্ড দেখে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের অবস্থা বলাই বাহুল্য। ঘন্টাখানেকের ভিতর ট্রেন সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আমাদের ফ্রান্সের ক্যালেতে পৌঁছে দিলো। বাসও দেখলাম দিব্যি প্ল্যাটফর্ম দিয়ে রাস্তায় উঠে দৌড়তে শুরু করলো। আরও ঘণ্টা দুয়েক পরে আমরা পৌঁছলাম ব্রুজের বাসস্ট্যান্ডে। ব্রুজ একটা পুঁচকে ছোট্ট শহর হলেও আকাশচুম্বী তার জনপ্রিয়তা। একটা ছোট পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ব্রুজের স্থায়ী অধিবাসীর সংখ্যা ১৯৫০০ আর ব্রুজে প্রতি বছর ভ্রমণার্থী আসেন প্রায় ৯০ লক্ষ, মানে স্থায়ী অধিবাসীর প্রায় ৫০০ গুণ বেশী। যাই হোক আমরা আমাদের হোটেলের পথে হাঁটা দিলাম। আমাদের হোটেলটা পরিকল্পনা মাফিক সিটি সেন্টার থেকে একটু দুরে ছিল কোলাহল ও ভ্রমণার্থীর আধিক্য এড়ানোর জন্য।
পরদিন সকালে আমাদের ছোট্ট ট্রিপের ব্রুজ অভিযান শুরু হলো। ব্রুজ শহরের প্রাণকেন্দ্রে খুব কাছাকাছির মধ্যে ছড়ানো ছেটানো আছে অনেক মণিমুক্তো। ব্রুজের প্রধান চার্চ ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি’, ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি ব্লাড, প্রভিনশিয়াল কোর্ট নামে এক সুবিশাল প্রাসাদ, বেল ফোর্ট সবই একই চাতালের এদিক ওদিক অবস্থিত। আর আছে অসংখ্য ছোট বড়, সরু মোটা ক্যানাল, এক অর্থে যা ব্রুজের লাইফ লাইন। এবং লাস্ট বাট নট লিস্ট, ছটা বিয়ার তৈরির ব্রিউয়ারি। ইউরোপের কোনও শহরে আমি এর আগে ছ ছটা ব্রিউয়ারি দেখিনি। শুধু তাই নয়, সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র পাব আর বিয়ার গার্ডেন। প্রায় প্রত্যেক দ্বিতীয় বাড়িটা একটা পাব বা বিয়ার গার্ডেন যাদের টার্গেট অডিয়েন্স হলো ৯০ লাখ টুরিস্ট। ব্রুজের ক্যানালের সৌন্দর্য আমস্টারডাম বা সেন্ট পিটারস্বার্গের থেকে কোনও অংশে কম নয়। ব্রুজের সব থেকে আলোচিত ক্যানালের নাম হলো রোজেনহোকাই। বাংলা নামের বানানটি যদি সঠিক না হয়, তাহলে আমি দুঃখিত। মাছ ভাত খাওয়া জিভে ওরকম দাঁত মুখ ভেংচানো নাম উচ্চারণ করা খুব একটা সহজ নয়। সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তায় তুলনাহীন এই ক্যনালটি।
সন্দেহাতীত ভাবে ব্রুজে সবথেকে বেশী ছবি তোলা হয় এখানে। আমরাও ‘say cheese’ বলে টলে খান কয়েক ছবি তুলে ফেললাম ক্যানালের সামনে দাঁড়িয়ে। এরপর গুটি গুটি পায়ে হাজির হলাম ব্রুজ সিটি সেন্টারে। ব্রুজের প্রাণকেন্দ্র হলো তার সিটি সেন্টার। ছোট্ট এই জায়াগটি ঠিকমতো দেখতে হলে দুদিন সময় অবশ্যই লাগে। আমরা ঢুকে পড়লাম ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি’ তে। ব্রুজের প্রধান ও সবথেকে বড় চার্চ হলো ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি’। চার্চের ভিতরের মার্বেলের কারুকাজ ও তেলরঙে আঁকা চিত্রসামগ্রী দেখে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। যদিও এই চার্চের প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই মাইকেল্যাঞ্জেলোর ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড। সাদা মার্বেলের তৈরী মেরী ও ছোট্ট যীশু মাইকেল্যাঞ্জেলোর হাতের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে সজীব, প্রাণবন্ত।
চার্চ অফ আওয়ার লেডির পাশেই আছে ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি ব্লাড। কালো পাথরের তৈরি ব্যাসিলিকার সাজসজ্জা বা আঙ্গিকটাই বেশ গা ছমছমে। এই ব্যাসিলিকায় যীশুর রক্ত সম্বলিত একটি কাপড়ের টুকরো আছে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা জনসাধারণকে দেখতে দেওয়া হয়। যদিও অত্যন্ত সুরক্ষিত ভাবে বাতাসহীন জায়গায় রাখা সেই কাপড় দেখে বোঝার উপায় নেই যে আদৌ কোনও রক্ত লেগে আছে কিনা, বা সেই রক্ত আদৌ যিশুখ্রীস্টের কিনা। তবে ভিতরের নাস্তিক মনটাকে মিনিট পাঁচেকের জন্য ভুলে থাকতে পারলে, কাপড়ের টুকরোটা দেখে শিহরণ জাগে বৈকি। পরের গন্তব্য বেলফোর্ট। ৮৩ মিটার উঁচু বেলফোর্ট মূলত একটি লম্বা টাওয়ার বা ঘন্টাঘর যা ব্রুজের সিটি সেন্টারের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ৩৬৬টি পেঁচানো, সরু স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে বেলফোর্টের ছাদে উঠলে হৃদপিণ্ড কয়েক মিলি সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি রইলো। সমগ্র ব্রুজ শহরকে পাখির চোখে দেখার এক অনন্য অনুভুতি হয় বেলফোর্টের ছাদে উঠলে।
আমাদের সারটাদিন এভাবেই কেটে গেলো এক ইতিহাস থেকে আরেক ইতিহাসের খোঁজে। সন্ধ্যাবেলা একগলা বিয়ার গলাধঃকরণ করে নিজনিকেতনে ফিরে এলাম। পরের দিনটা রাখা ছিলো ব্রুজের ক্যানাল আর ব্রিউয়ারি দেখার জন্য। ব্রুজ শহরে টুরিস্টদের জন্য সুদৃশ্য নৌকা ও গন্ডোলা ছাড়াও বিভিন্ন রুটের সাধারণ ছোট ছোট নৌকাও পাওয়া যায়। আমার মনে হয় একটা শহরকে চিনতে গেলে তার মানুষজনকে চেনা, তাদের সাথে কথা বলাটা খুবই প্রয়োজন। আর স্থানীয় মানুষকে বুঝতে গেলে গনপরিবহণের থেকে ভালো মাধ্যম আর কিছু হতে পারে না। আমরা একটা ডে টিকিট কেটে এদিক সেদিক করে ব্রুজ শহরের এমুড়ো ওমুড়ো ঘুরে বেড়ালাম অনেকক্ষণ ধরে। যতটা সম্ভব জলপথ থেকে শহরটাকে চেনার, জানার, বোঝার চেষ্টা করলাম।
অবশেষে হাজির হলাম শহরের সব থেকে বড় ব্রিউয়ারি ‘ডে হালভ মান’ ব্রিউয়ারিতে। সস্ত্রীক, সপুত্র এটাই আমার প্রথম ব্রিউয়ারি দর্শন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বিয়ার তৈরীর কলাকৌশল বোঝা হলো। কিঞ্চিৎ জ্ঞান লাভও হলো বিয়ায়ের ইতিহাস ও রসায়ন সম্বন্ধে। তবে সত্যি কথা বলতে কি ব্রিউয়ারি দর্শন কখনই হুইস্কি ডিস্টিলারি ভিজিটের মতো রোমাঞ্চকর মনে হলো না। যন্ত্র ও কলকব্জার আধিক্যহেতুতে ব্রিউয়ারিগুলো কখনই দৃষ্টিনন্দন হয় না। যাই হোক, ট্যুর শেষে ব্রিউয়ারির দেওয়া সৌজন্যমূলক বিয়ারের সদ্ব্যবহার করে আরেক দফা শহর চষতে বেরিয়ে পড়লাম।
দিনান্তে হাক্লান্ত হয়ে আমরা হাজির হলাম ব্রুজ বাস স্ট্যান্ডে, লন্ডনগামী ফেরার বাস ধরার জন্য। আরেক দফা বাসের ট্রেনযাত্রা চাক্ষুষ করে সেই সুড়ঙ্গ পেরিয়ে পরদিন ভোরবেলা নিজভূম লন্ডন পৌঁছে এবারের মতো সপ্তাহান্তিক বেড়ানোর ইতি ঘটলো। কিন্তু জীবনে কিছু জিনিস শেষ হয়েও হয় না। সেরকমই এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলে ব্রুজ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাহলো ব্রুজের মানুষজন। এরকম সদালাপী, প্রাণচঞ্চল, আড্ডাবাজ মানুষ আমি অন্তত দ্বিতীয় কোনও শহরে দেখিনি। হ্যাঁ, আথিতেয়তার জন্য বিখ্যাত প্যারিস বা প্রাগ কিংবা ভারতের লখনউকে মনে রেখেও আমি একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। বিয়ার পাবের বার টেন্ডার থেকে চার্চের পাদ্রী, ফুটপাথের আইসক্রিম বিক্রেতা থেকে নৌকোর চালক, কখনই মনে হয়নি আমরা বিদেশ বিভূঁইতে আছি, যাদের মাতৃভাষা বাংলা তো কোন ছার, এমনকি ইংরাজিও নয়। আমি যে সমস্ত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই আশ্চর্য রকমের বন্ধুত্বপ্রবণ। চাই বা না চাই, আমাদের উত্তর কোলকাতার মানুষজনের সাথে একটা তুলনা করতে ইচ্ছা হবেই, এই আড্ডা প্রিয়তা ও সদালাপের জন্য। আমাদের ব্রুজ বেড়ানো হয়তো মাত্র দুদিনের একটা সপ্তাহান্তিক ভ্রমণ ছিল, কিন্তু এই দু দিনে আমাদের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার অনেকটাই পরিপূর্ণ হয়ে গেলো, আর মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে গেলো ব্রুজ ও তার মানুষজন।
জরুরি তথ্যঃ
ইউরোপের প্রায় সব শহর থেকে ফ্লাইটে ব্রাসেল্স যাওয়া যায়। সেখান থেকে ব্রুজ ট্রেনে এক ঘণ্টা আর বাসে দেড় ঘণ্টা। পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব শহর থেকে সরাসরি ব্রুজ যাওয়ারও বাস বা ট্রেন পাওয়া যায়। বেলজিয়ামের মুদ্রা হল ইউরো, এক ইউরো কম বেশি পঁচাশি টাকা। সিটি সেন্টারের কাছে হস্টেলে মাথাপিছু খরচ ৩০-৭০ ইউরো প্রতি রাতে, আর ৭০-১৫০ ইউরোর মধ্যে হোটেলের ঘর বা অ্যাপার্টমেন্টের ঘর পেয়ে যাবেন। মোটামুটি সস্তা রেস্টুরেন্টে একজনের খাওয়া খরচ প্রায় ১৫-২০ ইউরো, ম্যাক্ডোনাল্ডে ম্যাক্মীল ৮-১০ ইউরো। কফি ৩-৫ ইউরো, বিয়ার ৪ থেকে ৮ ইউরো।