নাকের বদলে নরুন তত্ত্বের নীতি মেনে আমার এবার বড়ন্তী ভ্রমণ। আসলে হয়েছেটা কি, বছরে একটা বাইকট্রিপের অলিখিত পারমিশান আমি ঘর আর আপিশ থেকে মনে মনে নিয়েই রেখেছি, সে ওরা দিক আর না দিক। সেই পারমিশান মোতাবেক এবার গুরুদোঙ্গমার যাব ঠিক ছিল। ডিসেম্বরের বাইশ যাত্রা শুরু। একার পারমিশান পাব কি পাব না ভেবে একজন পার্টনারও জুটে গেছিল। অভিজিৎ। বিশেষ জানাশোনা না থাকলেও মনে হয়েছিল ট্যুরমেট হিসেবে ভালো। নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাইক নিয়ে গুরুদোঙ্গমার যাচ্ছি শুনে অনেকেই ভয় দেখালেন। কেউ বললেন পথ বন্ধ থাকবে, কেউ বললেন পারমিশান অনিশ্চিত। তবে যে কমেণ্টটা পড়ে আমার পরিবার কান মলে ঘরে আমায় বসিয়ে রাখার হুমকি দিলেন সেটা হ'ল, "ডিসেম্বরের বাইশে বাইক নিয়ে গুরুদোঙ্গমার যাওয়াটা একপ্রকার সুইসাইড অ্যাটেম্পট।" তার সাথে ব্ল্যাক-আইসটাইসের কীসব ফাণ্ডাও জুড়লেন। তাও ভেবেছিলাম যাব কিন্তু ট্যুরমেট হিসেবে যাকে পেয়েছি তার বাবার শরীরটা খারাপ হওয়ায় সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভাবলাম এত যখন বিপত্তি তখন নাহয় দিই ক্যানসেল করে। পরে দেখা যাবে খন।
যাক, ঠিক হ'ল কোথাও একটা যাব এবং পরিবার নিয়েই যাব। বউ নিয়ে একবার মন্দারমণি গিয়েছিলুম, তাও সে'টা পনেরো ষোলো বছর হয়ে গেছে। এখন আমরা তিনজন। তিনজনের জিনিসপত্র একটা স্যাডলব্যাগে ধরানো বেশ চাপের। ফতোয়া জারি করলাম। "একসেটের বেশি জিনিস কেউ নিতে পারবে না"। কাজ হয়ে গেল। ভাবলাম ছোটো করেই শুরু করা যাক। কাছেপিঠে মিষ্টি জায়গা তো অনেক আছে কিন্তু আমার আবার বেড়াতে গিয়ে পাহাড় না চোখে পড়লে বেড়ানোটাকে বেড়ানোই মনে হয়না। ঠিক হ'ল বড়ন্তী যাব। গুগলের হিসেবে জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে ২৩৭ কিলোমিটার হ'লেও পোঁছতে গিয়ে দেখলাম ২৪৫ কিলোমিটার পার হয়ে গেছে। যাক, বউবাচ্চা নিতে এতটা পথ এর আগে কখনও পাড়ি দেওয়া হয়নি। কতবার যে ওদের "পা-ব্যথা করছে"র ছুতোয় থামতে হবে তা'নিয়ে একটু টেনশানেই ছিলাম। সেই মোতাবেক শুক্রবার ভোর সাড়ে-পাঁচটায় রওনা দেওয়া হবে ঠিক হ'ল। আমাদের পরিবারে আমার মেয়ে বাদে সকলেই বেশ পাংচুয়াল। রওনা দিলাম পাঁচটা পঁচিশ। প্রথম হল্ট চল্লিশ কিলোমিটার পার করে সিঙুরের নবান্ন হোটেল। যেহেতু বেরোনোর আগেই ঠিক হয়েছিল শক্তিগড়ে ল্যাংচা সহযোগে জলযোগ করা হবে সেহেতু আমার স্ত্রী অন্য কোথাও ব্রেকফাস্ট করবেন না। উনি আবার এইসব ব্যাপারে খুব স্ট্রিক্ট। কিন্তু কন্যার ক্ষিদে পেয়ে যাওয়ায় নবান্নতে শুধু কন্যাকেই খাইয়ে আমরা শক্তিগড়ের উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। ওদের জানিয়ে দিলাম যে পরবর্তী ষাট কিলোমিটারেরর মধ্যে নো-হল্ট।
শক্তিগড়ে জলখাবার, পানাগড়ে পা-ব্যথা, রাণীগঞ্জে চা-তেষ্টা, আর বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ায় ঢুকেই মাড়বেদিয়া নামের একটা অখ্যাত জায়গায় "এবার একটু থামো বাবা"র হুমকিতে দাঁড়ানো, সবমিলে পাঁচবার হল্ট সেরে তিনজনের পরিবার পৌঁছে গেলাম বড়ন্তী। আমরা এই প্রথম বড়ন্তীতে এলাম। থাকা হবে 'লেক-হিলভিউ রিসর্ট'। আগেরদিনই কলকাতা থেকে বুক করেছিলাম। একটাই ঘর ফাঁকা ছিল। উইকএণ্ড তো, একটু বেশিই চাহিদা। ভাগ্য করে পেয়েই গেলাম একপিস ঘর। লোকমুখে শোনা এই হোটেলের বারান্দায় বসে লেক দেখা যায়। সত্যিই যায়। তবে আমরা যেহেতু গ্রাউণ্ডফ্লোরে ঘর পেয়েছিলাম তাই লেকটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। যাইহোক নো-প্রবলেম, সবমিলয়ে বেশ ভালো। ৯৫০টাকা ভাড়া, ঘরদোর খারাপ নয়। খাওয়াদাওয়াও বেশ ভালো। জনপ্রতি ৪০০টাকা প্রতিদিন। বেডটি টু ডিনার। ওই যেমন নিয়ম বাঁধা মেনু হয় তেমনই।
খরচের কথা যখন লিখছিই তখন আগে ভাগে একটা কথা বলে দিই। শুনে হয়ত চমকে যেতে পারেন। শুক্রবার সকালে বেরিয়ে রোববার বিকেলে বাড়ি ফিরেছি। সর্বসাকুল্যে আমাদের কত খরচা হয়েছে জানেন? ওনলি ৬৪২৩টাকা। এরমধ্যে বাইকের তেল থেকে শুরু করে মজুমদার নিবাসের দারোয়ানকে চা খেতে ২০টাকা দিয়েছি সেই হিসেবও রয়েছে, বিশ্বাস করুন।
বড়ন্তীর হোটেলে ঢুকলাম ঠিক দুপুর বারোটা পঁচিশ। পাক্কা সাতঘণ্টা সময় লাগল। একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম। খেয়েদেয়েই আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিনে মিলে। আশপাশটা ঘুরে দেখব বলে। বাঁধের পথ ধরে পুরোটা ঘুরলাম। সূর্যাস্ত দেখার আশায় জল ঢেলে দিল সকাল থেকে জমে থাকা মেঘেরা। বাড়ি থেকে যতটা এসেছি আমরা পুরো পথ জুড়েই কেমন একটা মেঘলা-মেঘলা ভাব। ধোঁয়াধোঁয়া আবহাওয়ার মাঝেও অপূর্ব লাগছিল বড়ন্তীকে। মিষ্টি একটা লেক আর এক পাড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মোলায়েম একটা পাহাড়। সঙ্গে মেঘ আর কুয়াশামাখা একটা অপরাহ্ন। খুব অবাক লাগছিল, এত জায়গায় ঘুরে বেড়াই আর হাতের কাছে এমন সুন্দর একটা জায়গায় আগে আসিনি ভেবে।
"আপনারা খেজুররস খেলে এখনই অর্ডার দিয়ে দিন। কাল ভোরে এনে দেব।"। রাতের খাবার দিয়ে হোটেলের ছেলেটি বলল। "একলিটার আশিটাকা। আসল খেজুর রস। আপনারা তো শহরে আর এইসব পান না।" এইসব শুনে একলিটার অর্ডার করে দিলাম। পরদিন ভোরবেলা থেকে উঠে বসে আছি। খেজুররস এলেন। আমি একগ্লাস নিলাম। খেলাম। আশিটাটাকা দিয়েছি তাই ফেলতে মায়া লাগল। "ভাইটি, আমরা এতটা খেতে পারব না, যদি আপনারা কেউ খান তো এখান থেকে নিতে পারেন।" ওরা নিল। রসটা ফেলে দিতে হয়নি।
সকাল সাড়ে-আটটা। লুচি, সেদ্ধআলুর তরকারি আর মিষ্টি সহযোগে জলখাবার সেরে সেজেগুজে আমারা তৈরি। প্ল্যান, গড়পঞ্চকোটে হাল্কা ঢুঁ-মেরে পাঞ্চেতবাঁধ দর্শন করে মাইথন পৌঁছনো। গুগলের হিসেবে ৪৫ কিলোমিটারের পথ আর ঘণ্টা দুয়েকের মত জার্ণি। তবে জায়গাগুলো দেখে, ফটোসেশান-টেশান করে, মাইথন পৌঁছতে সাড়ে-বারোটা বাজল।
গড়পঞ্চকোটে পাহাডের মাথায় একটা নাকি মন্দির রয়েছে। সে অনেক ঠেঙিয়েঠুঙিয়ে উঠতে হবে বলে আর গেলাম না। ওয়াচটাওয়ারটায় উঠে যেটুকু দেখা যায় সেটুকুই দেখলাম। নেমে আসার সময় "অ্যাই কুমড়োফুলের বড়া" শুনে একটু থমকেই গেলাম! দেখলাম বড়াভাজা বিক্রি হচ্ছে এক দোকানে। চা আর কুমড়োফুলেরবড়া সাঁটিয়ে আবার ব্রুমব্রুম। সোজা পাঞ্চেত। লেকের মাঝখানে আবার একটা আদ্দেক তৈরি হওয়া ব্রিজও রয়েছে। বিশাল লেক! বোটিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে দেখে কন্যা তো আমার বায়না ধরে বসলেন। "মাইথনে পাওয়া যাবে" এরকম একটা সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বাইকে তুললাম।
মাইথন পৌঁছেও একই কথা মনে হ'ল। নিজেকে আবার বকাঝকা করলাম। "হাতের কাছে এমন একটা মনোরম জায়গা তুই কিনা অ্যাদ্দিনেও একবার আসতে পারলি নি পিকলু?!" ইচ্ছে ছিল এখানে মজুমদার নিবাসে থাকব। উল্টোডাঙায় আমার অফিস হওয়ার সুবাদে ডিভিসির এই হোটেল বুক করা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। হ্যাঁ, কঠিন নয় তবে ডিভিসির সরকারি চাকরি করা লোকগুলো যদি আপনাকে এণ্টারটেন করেন তবে। আসলে বেশিরভাগ সময় উনারা আপনাকে পাত্তাই দেবেন না, ফলত মজুমদার নিবাসে থাকার আপনার যে স্বপ্ন ছিল সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে। মজুমদার নিবাসটা ঠিক যেন দিঘীর জলে ফুটে থাকা একটা পদ্মফুল। ২০১৬-তে বড়ন্তীতে এসে আমাদের এই মজুমদার নিবাসেই থাকার কথা ছিল। যাক বাদ দিন সে কথা, সবসময় সরকারী চাকুরেদের বদনাম করতে ভালোও লাগেনা।
পথের বাঁহাতে বিশাল লেক দেখতে দেখতে আমরা মাইথনের 'বোটঘাটে' এসে পৌঁছলাম। নৌকো চড়ার টাইমিংটা কনফার্ম করে নিয়ে হোটেলে ঢুকে গেলাম। যদিও আগে থেকে বুকিং ছিলনা। শুনেছিলাম শান্তিনিবাস বেশ ভালোই হোটেল। ঢুকে পড়লাম। নন-এসি রুম ১২৫০টাকা। আমার পরিবারের এই একটা ভালো দিক যে শীতকালেও এসি হোটেলে থাকতে হবে এমন কোনও বায়না নেই। ১২৫০টাকায় দারুণ ঘর তবে সেই দামি হোটেলের মত বেশি নরম বিছানা যেগুলো আমাদের একদম পছন্দ নয়। এই কারণেই আমরা দামি হোটেলে থাকি না।
হোটেলে চেক-ইন করেই লটবহর রেখে সোজা নৌকোঘাটে। গুনগুনের ইচ্ছে ছিল পেডালবোট চড়ার। সেটা পাওয়া গেলনা বলে নিদেনপক্ষে দাঁড়বাওয়া নৌকোর কথা বলছিল। ওর মায়ের আবার নৌকোয় উঠতে ভয়। শ্যাম-কূল দুটোই রক্ষে হ'ল যেই বললাম, "স্পিড বোটও আছে, যাবে?" কী বুঝলেন কে জানে, উনি রাজি হয়ে গেলেন। যাক, জীবনে প্রথমবার আমরা স্পিডবোটে চড়লাম। দারুণ অভিজ্ঞতা! দাঁড়বাওয়া নৌকোয় যে ট্রিপটা একঘণ্টার সেটাই স্পিডবোটে সাতমিনিট সময় লাগল। মাইরি বলছি প্রথমে খুব ভয় হচ্ছিল। আমাদের তিনজনের মধ্যে আমিই শুধু সাঁতার জানি। ডুবে গেলে না পারব ওদের দুজনকে একসাথে বাঁচাতে আর না পারব একা একা বাঁচতে। নিজেকে এইভাবে মরে যেতে হবে ভেবে বেশ চিন্তাই হচ্ছিল। তারপর ভাবলাম লাইফজ্যাকেট তো আছে। যাক সেসব বাদ দিন, স্পিডবোটে চড়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা সে আপনি যাই বলুন। মাইরি, মনে হচ্ছিল জলের ওপর দিয়ে মসলন্দপুর টু বাদুড়িয়া ট্রেকার চেপে চলেছি তাও হেব্বি স্পিডে। জলের ওপর মাঝেমাঝে কেন যে মালটা ঢকঢক করছিল কে জানে! যাই হোক ব্যাপারটা হেব্বি থ্রিলিং!
নৌকোঘাটের সামনেই যে দোকানগুলো রয়েছে ওখানেই দুপুরের খাবার সারলাম। তারপর ইতিউতি একটু ঢুঁ মেরে সোজ্জা হোটেলে। ও হো, মজুমদার নিবাস মজুমদার নিবাস। বাইকটা বাইরে রেখে ঢুকেই পড়লাম মজুমদার নিবাসে। মূল বাড়িটা তো জলের ওপর তাই কানেক্টিং একটা সেতু মতন আছে। কী বলব আপনাদের, এত কম খরচে এত রোম্যাণ্টিক জায়গায় আগে কখনও যাননি। দু-দিকে জল আর আপনি হেঁটে চলেছেন হোটেলের দিকে। একপাশে আবার একটু পাহাড়পাহাড়। উফফ্!
ভেবেছিলাম পরদিন বারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দেব। হোটেলের ঘরে ঢুকে টিভি চালিয়ে জানতে পারলাম রাজ্যের দিকে দিকে গণ্ডগোল চলছে। আগুন জ্বেলে পথ-অবরোধ, ট্রেন বাস পোড়ানো, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্ল্যানটা বদলেই নিলাম। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম পরদিন। সাড়ে-আটটা। ঘণ্টা খানেক চালিয়ে এসে রাণীগঞ্জের কাছাকাছি পাঞ্জাবি মোড় না কী একটা জায়গায় এসে জলখাবার খেলাম। কচুরি মিষ্টি। সাতটাকা পিসের মিষ্টি তাক লাগিয়ে দেবে মশাই। যেমন সাইজ তেমন স্বাদ!
বর্ধমানে লাঞ্চ, শক্তিগড়ে ল্যাংচা, সিঙুরে চা, ইত্যাদি হ্যাড্ডাব্যাড্ডা সেরে ডানকুনি মোড়ের ঠিক এককিলোমিটার আগে আটকে গেলাম। আগেভাগে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিয়ে সারা পথ নির্ঝঞ্ঝাট এলাম আর ঘরের কাছে এসে কিনা আটকে গেলাম! বিশাল মিছিল। বিশাল মানে বিশাল। সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। বিক্ষোভকারীরা গাড়ি থেকে লোকজন নামিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছেন। কারো হাতে বড় বড় জাতীয় পতাকা, কারো হাতে প্ল্যাকার্ড, কেউ বা মোবাইলে ভিডিও করছেন। সাহস নিয়ে ঢুকেই পড়লাম মিছিলের ভেতরে। পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সাথে পরিবার থাকলে সবকিছুতেই একটা আলাদা সম্ভ্রম পাওয়া যায়। এমনকী পরিবার সাথে থাকলে ট্র্যাফিক পুলিশও মুখে অ্যালকোহল ডিক্টেটার ঢোকায় না। সেই কনফিডেন্সকে সঙ্গী করেই মিছিলের মধ্যে ঢুকে গেলাম। মিছিলমানবেরা আমাদের জায়গা করে দিলেন। বললেন পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যান, কোনও সমস্যা নেই। জাতীয়পতাকার ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় আমরা ধীরেধীরে মিছিলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এলাম বাড়ির পথে। বেড়িয়ে এলাম ছোট্টো উইকএণ্ড।