ভারতের কিছু বনাঞ্চল ভ্রমণের সুবাদে, যার মধ্যে উত্তরবাংলা, উত্তর পূরবাঞ্চল, দক্ষিণ ভারত, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছোটনাগপুর মালভুমি অঞ্চল, পশ্চিম ভারতের গুজরাট- এ যা সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে মানস জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণকে আমি পৃথক জায়াগায় রাখি। তার অন্যতম কারণ বোধহয় এই যে এর অবক্ষয় এবং পুনর্জীবন দুইই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, যদিও অবক্ষয় দেখা কখনই সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। তবু এ যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখিকে উপলব্ধি করা।
মানসে প্রথম যাই ২০১০এ , দ্বিতীয় বার ২০১৯এ। দুবারই একটা অনুভূতি বহাল থেকেছে তা হল এই যে এই বনাঞ্চল অনান্য সব বনাঞ্চলের থেকে তার কৌমার্য রক্ষায় ছাপিয়ে যায় – এ যেন চিরকুমারী।
ফিরে তাকালে আজও মানস নদীর ধারে মাথানগুড়ীতে শিরশিরে ঠাণ্ডায় পূর্ণিমার চাঁদের রুপালী মায়া, দূরে ভূটান পাহাড়ের মৌন অবস্থান যেন অবন ঠাকুরের ধোয়া জলরং এর ছবি। আর সঙ্গে মানসের (স্থানীয় ভাষায় বেকী ) কলধ্বনি। রাত বেড়েছিল। সবাই প্রস্তর মূর্তির মত বসে থেকেছি, কি এক অব্যক্ত দেওয়া নেওয়া চলেছিল প্রকৃতির সঙ্গে।
মানস তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। চোরাশিকারি আর বোরো আন্দলনের সমান্তরাল আক্রমণে, গন্ডার নিশ্চিহ্ন। মানস ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠছে এমন এক সন্ধিক্ষণে আমাদের গমন, মাঠানগুড়ি আপার ইন্সপেকশ্ন বাংলোতে থাকা। বরপেটা রোড থেকে সমস্ত কাঁচা রসদ কিনে আনা। যাঁরা তত্ত্বাবধানে ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন বোরো সম্প্রদায়ের- আতঙ্কবাদীদের অত্যাচারের চিহ্ন ছিল তাদের চোখে মুখে। রান্না-বান্না সব তাঁরাই করে দিয়েছিলেন – চার বেলাই। সন্ধ্যে ৬টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত ছিল জেনারেটরের আলো। বরপেটা রোড থেকে যা কিনে এনেছি তাই পাক করে আমাদের পাতে দেওয়া, এ যেন , ‘আমি যা দিতেছি সে তোমারই দান-‘….. এর মতো। ঐ সময় কোন পরিকাঠামো ছিল না বললেই চলে। তবু চেষ্টা করে তাঁরা একদিন রাত সাফারির ব্যাবস্থা করেছিলেন। এক বিশাল মাকনা হাতীর তাড়া খাওয়া আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
একটু পিছনে তাকাই। ১৯২৮ সালের পয়েলা অক্টোবর যখন মানস জাতীয় উদ্যানকে স্যাংচুয়ারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখন এর এলাকা ছিল ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭৩-এ সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণার পর এই বনাঞ্চল মূলত কোচবিহার আর গৌরীপুর রাজপরিবারের শিকারের জন্যেই ব্যবহৃত হত। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এর এলাকা বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ৩৯১ বর্গকিলোমিটার । তখন এই বনাঞ্চলকে মানস রিসার্ভ ফরেস্ট ও কামরূপ রিসার্ভ ফরেস্ট বলা হত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো মানস বনাঞ্চলকে বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ১৯৯০ তে কাকিলামা, কোকিলাবাড়ি ও পানবাড়ি রিসার্ভ ফরেস্টকে মানসের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং প্রায় তার পরে পরেই মানসের ভাগ্যাকাশে অন্ধকার নেমে আসে। ভারতের আর কোনও বনাঞ্চলকে এই ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি।
১৯৮৬ সালে বোরো সিকিউরিটি ফোর্স সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে, ১৯৯৪এ তার নাম হয় এন ডি এফ বি। ১৯৯৬এ বোরো ও আদিবাসীদের মধ্যে জাতিদাঙ্গা শুরু হয়। এই সময় ভুটান – আসাম সীমান্তে এন ডি এফ বি ১২ টি ক্যাম্প স্থাপন করে, যাকে কেন্দ্র করে সুরু হয় ব্যাপক চোরাচালান (poaching) এবং বনাঞ্চল দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে । ১৯৯২ ইউনেস্কো-র পুনর্বিবেচনায় মানস ন্যাশনাল পার্ককে 'List of World Heritage in Danger' -এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ভিত্তিতে ভূটানের রয়্যাল ভুটান আর্মির 'অপরেশন অল ক্লিয়ার’ সক্রিয় হয় এবং ২০০৫-এ সিজফায়ার ঘোষিত হয়।
২০০৭ এ পুনর্গঠন শুরু হয়। প্রায় সব বড়ো প্রাণীর অস্তিত্বই লোপ পেতে বসেছিল। ২০০৭-এ এক জোড়া গন্ডার পুনরস্থাপিত করা হয়। আমরা অবশ্য ২০১০ এ গণ্ডারের দেখাই পাইনি।
২০১০-এ আমরা আলিপুরদুয়ার থেকে ভাড়া করা গাড়িতেই সাফারি করেছিলাম, সঙ্গে অবশ্যই সশস্ত্র বন রক্ষী ছিলেন।
২০১৯-এ মার্চ মাসে আমরা দ্বিতীয়বার মানস যাই। প্রায় ১০ বছর পর মানস যাওয়া। প্রথম মানস দর্শন আমাদের এতো মুগ্ধ করেছিল যে এই ১০ বছরে অনেক বার চেষ্টা করে শেষে ২০১৯-এ সফল হই। মানসের শ্যামলিমা প্রতিবারই আমাদের মুগ্ধ করেছে । অবশ্য মানসের সঙ্গে যোগসূত্রও এক শ্যামলের মাধ্যমে তিনি হলেন শ্রী শ্যামল দত্ত, ইনি বাঁশবাড়ি লজের ম্যানেজার। ২০১০এ মাথানগুড়ি থাকার ব্যবস্থাও ইনিই করে দিয়েছিলেন। ২০১৯ এ আমরা বাঁশবাড়িতে থাকার মনস্থ করি কারণ এখান থেকে সাফারি বন্দোবস্ত করা অনেক সুবিধেজনক, আর পাখি চেনানোর গাইডের ব্যবস্থাও করা সম্ভব। এখন বাঁশবাড়ি লজের একটু জীর্ণ অবস্থা হলেও এখানের খাবারে বৈচিত্র্য আছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন পদ থাকবেই, বিশেষ করে মাছে আর ডেসের্টে। আর এ ব্যাপারে কর্মীদের উৎসাহ উদ্দীপনা অন্তহীন।
আমরা যাত্রা শুরু করি ২০১৯ এর ১১ই মার্চ ভোর বেলা। দমদম থেকে ৬-৩০ মিনিটের উড়ান। সকাল ৮-র মধ্যে লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলুই বিমান বন্দরে ( গুয়াহাটি) অবতরণ করি। বাঁশবাড়ি লজের মাধ্যমেই গাড়ীর ব্যবস্থা করা ছিল। বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। দুলালবাবু ঝড়ের গতিতে ( এবং এটা ভয়াবহ ভাবে আক্ষরিক অর্থে সত্যি ) নিয়ে চললেন । মাঝে যদিও সৌভাগ্যক্রমে প্রাতঃরাশের বিরতি দিয়েছিলেন। আমরা ১২টা নাগাদ বাঁশবাড়ি লজে পৌঁছলাম।
বাঁশবাড়ি লজ থেকে মানসের প্রবেশদ্বার
রাজনৈতিক ভাবে মানস জাতীয় উদ্যানের অবস্থান ৬টি জেলা জুড়েঃ চিরাং, বাস্কা, কাঁকড়াঝোড়, দারাং, উদালগুড়ি, ও বঙ্গাইগাঁও। বর্তমান এলাকা ৯৫০ বর্গ কিলোমিটার। এই উদ্যানটি তিনটি রেঞ্জে বিভক্ত। পানবাড়ি পশ্চিম অংশ, মধ্যভাগ বাঁশবাড়ি ( বরপেটা রোডের কাছে ) এবং ভূঁইয়াপাড়া, পাঠশালার কাছে। এক রেঞ্জ থেকে অন্য রেঞ্জে যাওয়ার পথ আদৌ সুগম নয়। সেই জন্যে পর্যটকেরা বরপেটা রোড ধরে এসে বাঁশবাড়ি রেঞ্জের বনাঞ্চল এবং মাথানগুড়ি ভূটান বর্ডার দেখে থাকেন।
দুটোর সময় আমাদের সাফারি ঠিক করাই ছিল। আমরা সময়টা আধঘন্টা পিছিয়ে আড়াইটের সময় করে নিলাম ( মানসে এই দরাদরিটা সম্ভব। )
স্নান, মধ্যাহ্নভোজ সেরে যাত্রা শুরু করলাম।
আমাদের এবারের মানস ভ্রমণের মুখ্য লক্ষ্য ছিল Bengal Florican ( Houbaropsis Bengalensis ) দেখা আর পারলে তার ছবি তোলা। Bengal Florican অত্যন্ত বিরল প্রজাতির পাখি, সেই কারণে শ্যামলবাবু বিশেষ বার্ড গাইডের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই দিলীপকে যেই Bengal Florican এর কথা বলা হল তিনি এমন নির্বিকার ভাবে বললেন ‘কাল দিখায়েঙ্গে’, মনে ভেবেছিলাম কিরে বাবা ফাজলামি করছেন নাকি? আবার এ ভাবনাও এল যে সত্যি দেখতে পেলে আমার তো আবার ব্রিজ ক্যামেরা, ছবি উঠলে হয়।
প্রথম দিনেই আমরা টের পেলাম যে মানসের জীব বৈচিত্র্য বেশ সমৃদ্ধ , আর হাতীর সংখ্যা যথেষ্ট সন্তোষজনক, হয়ত বা আশাতীতই। আর আমাদের ২০১০এ যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবারও সেটা বহাল থাকলো। এখানকার হাতীরা বেশ অসহিষ্ণু। তাদের গর্জন প্রায় কোথাও না কোথাও রোজ শোনা গেছে আর সঙ্গে ব্ল্যাংক ফায়ারের শব্দ। সাফারি জীপের সংখ্যা খুব বেশী ছিলো না।
এখানে আর একটা শান্তির কারণ হল অন্য কোন জঙ্গলের সাফারিতে মূল প্রার্থিত দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে বাঘ ( মূলত টাইগার, অবশ্য এটাও ঠিক যে ঐ বনাঞ্চলগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাইগার রিসার্ভ) সেখানে প্রত্যেকটি জীপের গাইড, পর্যটক এমন কি জীপের চালকও বাঘ ছাড়া জঙ্গলে যে আর কিছু দেখার থাকতে পারে এটা বিশ্বাসই করেন না। শুধু জঙ্গলের সান্নিধ্যও যে উপভোগ্য হতে পারে এ তাঁরা মানবেন না। আমার তো কত বার ইচ্ছে হয়েছে যে সারাটা দুপুর বিজরানীর বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিই – দ্বিপ্রহরের তপ্ত হাওয়ায় দূরের বনপ্রান্তরের গাছপালা তির-তির করে কাঁপবে, হঠাত একটা Black Redstart বেখেয়ালে বারান্দায় উঠে পড়ে থাকা বিস্কুটের গুঁড়ো ঠোকরাবে। দূরে তাকিয়ে দেখব হাতীর পিঠে সাওয়ারি হয়ে ব্যাস্ত পর্যটকরা সার বেঁধে চলেছে। ঠিক সেই সময় শিবালিক থেকে ধেয়ে আসা এক দমকা ঠান্ডা বাতাসে কিছু ধূলো পাক খেতে খেতে ওপরে উঠবে আর বেড়ার ওপারে অপার বিস্ময় স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকবে কয়েকটা চিতল …….তা সে তো হবার যো নেই। বাস্তবে কি হয়? হঠাৎ খবর হোল যে ধিকালা মে সাইটিং হো রাহা হায়, ব্যাস পড়িমরি করে জঙ্গলের সমস্ত নিয়ম কানুনকে নস্যাৎ করে ঘন্টায় ৮০ মাইল বেগে গাড়ী ছুটিয়ে চলল গাইরাল থেকে ধিকালা!
বাঁশবাড়ি লজ মানস জাতীয় উদ্যান প্রবেশদ্বারের একেবারে কাছেই। প্রাথমিক চেকিং লজ থেকে বেরোনোর সময়ই হয়ে যায় – চেকিং মানে ফটো আই ডি, ক্যামেরা, মোবাইল (অনুমতি নেই) ইত্যাদি। উদ্যানে ঢুকে প্রথমেই সশস্ত্র গার্ড উঠলেন জীপে। এক ঝলক চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ডানদিকে হাতির পিঠে চড়ার সিঁড়িযুক্ত সিমেন্টের মঞ্চ। বাঁ দিকে একটা বড় শিরীষ জাতীয় গাছে কয়েকটা পাহাড়ী ময়না বসে। নরম রোদ, জীপ চলছে ধীর গতিতে। দিলীপ আমাদের পাখির গাইড, বয়েস বেশী না। অবশ্য উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানুষের বয়স বোঝা একটু কঠিন। তার সঙ্গে দূরবীন আর বহু ব্যবহারে জীর্ণ ইন্সকীপ।
সশস্ত্র গার্ড ড্রাইভারের পাশে বসে, প্রথমে মনে হয়েছিল এত শান্ত বনপথে এ অস্ত্রসজ্জা বাতুলতা, এর প্রয়জনীয়তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। পাখির ব্যাপারে গার্ড মশাইও কিছু কম যান না, টুক টাক দেখাতে লাগলেন, আর যেহেতু ড্রাইভারের পাশেই বসা, তাঁর কিছু ইন্টারেস্টিং মনে হলেই উনি গাড়ী থামাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে দিলীপ পেছনের সিটে থাকার দরুণ একটা ল্যাগ কাজ করছিল।
অনেক স্বাস্তিতে দেখা আর ছবি তোলার কাজ চলছে, সেই ইঁদুর দৌড় নেই। চারিদিকে সবুজের সমারোহ আমার দুর্বল দৃষ্টি ও যেন উজ্জিবিত হয়ে ওঠে।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ফেরার পথ ধরা হল, কারণ ভিসিবিলিটি বেশ কমে আসছিল। ফেরার পথে জীপের আলোতে রাস্তায় Large-tailed Nightjar পোকা ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো বারে বারে।
লজে ফিরে চা পেলাম। লজের ক্যাম্পাসে প্রচুর গাছ। সেখানে কোন গাছে প্যাঁচার আস্তানা আছে লজের কর্মীরা সে সব বলতে লাগলেন। তবে ওসব জায়গা বেশ অন্ধকার। সতেজ দৃষ্টিধারীরা প্যাঁচার খোঁজে গেলেন কিন্তু সুবিধে হয়নি। আড্ডা চলছিল মাঝে মাঝেই একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম, সে কথা বলাতেই ওঁরা বললেন একটা ব্ল্যাক প্যান্থার তার একটা শিকার (সম্বর) বাঁশবাড়ির অন্য গেটের কাছে রেখেছে। প্রায়ই সন্ধ্যের পর সে আসে, লজের অনেকেই দেখেছেন, এমনকি মোবাইলে ছবিও তুলেছেন। ব্যাস সবাই হই হই করে ওদিকে ছুটলেন। এত হুড়োহুড়িতে জন্তুটি আর কখনো আসে!
বাঁশবাড়িতে ভোরবেলা ঘরে ঘরে চা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সাড়ে সাতটায় সকালের সাফারি, তাই সকালে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক যাওয়ার বেশ খানিকটা সময় পাওয়া যায় ।
আমরা ছাড়া আর কোন গাড়ীর উপদ্রব নেই, নেই ডলারের দৌরাত্ম্য, আমরা ভাগ্যবান। যে কোন বনাঞ্চলই ভোর বেলায় এক অপরূপ পবিত্রতা নিয়ে ধরা দেয়। এখানে কী যে আপরুপ, স্নিগ্ধ এই সূর্যোদয়! গাছ থেকে গাছে ময়ূর উড়ে যাচ্ছে, হাতীরা সার দিয়ে সাফারিতে যাচ্ছে, এ দৃশ্য ভোলার নয়।
কিছুটা এগিয়ে সামনেই পড়ল এক বন্য হাতীর দল, সঙ্গে বেশ কয়েকটা বাচ্চা। গার্ড ভীষণ সতর্ক হলেন, আমাদের কথা বলতে বারণ করলেন, তিনি বন্দুক রেডি করলেন। আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। মরেছে, গোলা গুলি চলবে নাকি? হাতির দলে, প্রায় ১৫-২০ টা হাতী নিজেদের মধ্যে জায়গা বদলাবদলি করছে আর গর গর করছে রাস্তা পার হচ্ছে না, ঠায় দাঁড়িয়ে। গাড়ী ও দাঁড়িয়ে। বেশ কিছুটা সময় পর হস্তী যূথ মাঝখানে বাচ্ছা দের রেখে তিন খেপে সতর্ক হয়ে গর গর করতে করতে রাস্তা পার হল, আর কেবল মাত্র তখনই আমরা ছবি তোলার অনুমতি পেলাম। উঠতি বয়েসের হাতীগুলো বড্ড খামখেয়ালি আর খামোকা ভয় দেখায়। আমাদের গোটা ট্রিপের মধ্যে একবারই ব্ল্যাংক ফায়ার করতে হয়েছিল, সে হাতী (দাঁতাল) একেবারে গর্জন করতে করতে শুঁড় তুলে ধুলো উড়িয়ে পিছনে তাড়া করেছিল, কি সাঙ্ঘাতিক!
সকালের ট্রিপে জীপেই প্রাতরাশ লজ থেকে দিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, বাঁশ বাড়ী লজের ঘর ভাড়ার সঙ্গেই চার বেলা খাবারের দাম ধরা থাকে। প্রাতরাশ দেখে খুব তৃপ্তি হল, হাতে গড়া আটার রুটি ,ফুলকপির তরকারি, মিষ্টি, পাকা কলা, আপেল, পানীয় জল আর চা। একটা বীট আফিস, সঙ্গে নজর মিনার এমন একটা নিরিবিলি শান্ত গ্রাম্য পরিবেশে আমাদের নামালেন দিলীপ। ভারি সুন্দর জায়গাটা, খোলা মেলা, নজর মিনারে উঠে দেখি এখানে পাখি, হাতী, মোষ, গন্ডার , গাউর সব কিছুর সহাবস্থান। দিলীপ বললেন এখানেই Bengal Florican দেখা যাবে। আমরা ত হতবাক, মনে মনে ভাবি ইনি নিশ্চই ফাজলামি করছেন!
উত্তর না দিয়ে দূরের ঘাস বনের দিকে দেখতে লাগলেন। আমরাও ওঁর নকল করছি বোকার মত, আমাদেরই একজন তখন বললেন, “ঐ কালো মত একটা বিন্দু নড়ছে, ওটা নাতো?” আমরা সবাই (বিশেষ করে উনি মহিলা বলে) খুব হাসাহাসি করলাম। দিলীপ চোখে বাইনো লাগিয়ে ওই মহিলাকে দেখিয়ে বললেন, "হ্যাঁ ওটাই, আপনি ঠিক দেখেছেন! ওটাই Bengal Florican!"
তারপর তো সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! আমারা সত্যি ই সেই বিরল পাখিটি দেখছি! যা কিনা এখানে ছাড়া কাম্বোডিয়া আর ভিয়েৎনামে আছে। সব মিলিয়ে কয়েক শো? খাওয়া ভুলে সবাই শৈশবে ফিরে গেলাম। এবার অপেক্ষা এর উড়ান দেখার। চোখে একবার ক্যামেরা আর একবার বাইনো দিয়েই আছি, হঠাৎ স্বপ্ন পুরণ। হ্যাঁ! ঐ তো Bengal Florican এর টিপিকাল ব্রিডিং ফ্লাইট, পুরুষ পাখির ডিসপ্লে, যা এতদিন শুধু বইতেই দেখেছি। বার বার দেখলাম। হল ছবি ও।
এশিয়ান ফেইরি ব্লু বার্ড
মন রাগ ভাটিয়ার এ গুন গুন করতে লাগল “ একি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়…….” বাকি দিন গেল ঐ আলোচনাতেই। ঠিক হলো পরেরদিন সকালেই আবার আসব এখানেই!
পরেরদিন খুব একটা সুবিধে হল না। যাওয়ার পথে অনেক অন্য পাখি দেখা হল, যেমন, Asian Fairy Bluebird, Sultan Tit, Chestnut capped Babbler, Rosy Minivet, Gray-backed shrike, Stone chat, Grey Bushchat, Red breasted parakite আর ও অনেক ছোট পাখি।
চেস্টনাট ক্যাপ্ড ব্যাবলার
রোজি মিনিভেট
দুপুরে আমরা গেলাম মানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল একটি নজর মিনারে যাকে এখানে বলে বুঢা বুঢি ওয়াচ টাওয়ার। সে ও এক অভিজ্ঞতা! সুসংগঠিত হাতীর সমাবেশ- সে দেখার মত। নানা বয়েসের প্রায় ৬০ /৭০ টি বন্য হাতী এক সঙ্গে। আর আমরা নজর মিনারের কাছে, মাঝের দূরত্ব মোটে ১০০ ফুটের মত। ওরা নিজেদের মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তর্জন গর্জন করছে, আরও মজার কথা সীমা নির্দেশ হিসেবে দুটি ছোটো লাল পতাকা, ব্যাস। কোনোদিন ওরা ঐ সীমানা পেরিয়ে আসেনা। কেন? জানা নেই!
পরেরদিন মাথানগুড়ি যাওয়া হোল। অনেক গুলো লক্ষ্য নিয়ে যাওয়া ওখানে । ওখানেই Great Hornbill এর ভূটান থেকে যাওয়া আসা চলে। আর এই ভূটান ভারত সীমানাই এন ডি এফ বি আর বোরো লিবারেশন টাইগারর্স গ্রুপের কনফ্লিক্টের জায়গা ছিল। যাওয়ার পথে Rufus-necked Laughing Thrush আমাদের বড্ড নাজেহাল করেছিল, কিছুতেই ভাল ছবি নিতে পারলাম না। দেখলাম Capped Langur, Emerald Dove, Imperial Pigeon, Yellow Footed Green Pigeon, Collared Falconet এবং GREAT HORNBILL!
মানসে এর পর মাথানগুড়ি ইন্সপেকশন বাংলোতে এলাম। এলাম প্রায় দশ বছর পর। বেশ সাজ গোজ বেড়েছে, কিন্তু সেই গ্রাম্য সরল মাথানকে পেলাম না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, ওখানকার মানুষ জনকে বললাম যে এটাই আমাদের আশ্রয় ছিল দশ বছর আগে। বিশেষ পাত্তা দিলেন না, যে দুটো ঘরে ছিলাম বাইরে থেকে দেখলাম, ঘরের সংখ্যা বেড়েছে, রসুই ঘর দেখলাম। শেষে দাঁড়ালাম মানসের ধারে সে তেমনই বয়ে চলেছে, একটা Red breasted Mergenser জলে ডুব দিচ্ছে, অবাক করে দিয়ে আগেরমত একটা Great Cormorant জলের কোল ঘেঁষে উড়ে গেল। সূর্য ডুবছে ভূটান পাহাড়ের আড়ালে, মানস রাঙ্গা হয়ে উঠল, বললাম ওকে, আমি কথা রেখেছি, বলেছিলাম আসবো। বিষন্ন সন্ধ্যা বলে উঠল কোথায় ছিলেন এতদিন?
বললাম আবার আসব। কথা দিলাম।
ছবি:স্বপন সেন
যে সব পাখির ছবি তুলেছি: Hill Myna, Indian Peafowl ,Crested Serpent Eagle, Rosy Minivet, Indian Pigmy Woodpecker, Great Pied Hornbill, Spot-billed Pelican, Eastern Baya Weaver, Lesser Adjutant, Gray backed Shrike, Stone chat, Chestnut Capped Babbler, Grey Bush Chat, Blue-throated Barbet, Asian Fairy Blue Bird, Red breasted Parakeet, Plum Headed Parakeet, Collared Falconet, White Wagtail, Sultan Tit, Great Cormorant, Kaleej Pheasant, Common Woodshrike, Large Woodshrike, Leafbird, White-rumped Shama, Black-naped Blue Monarch, Oriental Turtle Dove, Long tailed Broadbill, Black-hooded Oriole, Scarlet Minivet, Green billed Malkoha, Jungle owlet, Asian Barred Owlet, Dollar Bird, Large Niltava, Drongo, Hoopoe, River Lapwing, Ruddy Shelduck.