সে দিন এক লম্বা রাস্তা পাড়ি দেওয়া। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। পেরোনো ছ’টা কাউন্টি। কাউন্টি হলো প্রদেশ, আমাদের যেমন রাজ্য, কেনিয়ার তেমন কাউন্টি। তবে সংখ্যাগুলো বড়ো কথা নয়, জরুরি হলো তার অপার বৈচিত্র।
রওনা হয়েছিলাম নৈভাসা নামে এক পাহাড়ি শহর থেকে। জায়গাটা মধ্য কেনিয়ায়। সেখানে প্রচুর ছোটো ছোটো পাহাড়, বিশাল বিশাল লেক, আর ঘন সবুজ জঙ্গল। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বলতে যা বোঝায়, তা-ই। অতএব, সকালে যখন যাত্রা শুরু হল তখন আকাশ মেঘলা, বাহনও বারিধারাসিঞ্চিত, আমার বর্ষাপ্রেমী মনও উৎফুল্ল। সঙ্গত রেখে টি-শার্টের ওপর শার্ট, তার ওপর হাল্কা জ্যাকেট। গাড়ি যত এগোল, পাল্টাল ল্যান্ডস্কেপ। পোশাকও। রুক্ষতা বাড়ল, বাড়ল উষ্ণতাও। এমনিতে এই বদল কিছুটা পরিচিতই ছিল, কেননা নাইরোবি চেনা জায়গা। তবে তার দক্ষিণে গেলেই যে সবুজ এত কৃপণ, তা জানা ছিল না। তানজানিয়া বর্ডারের দিকে যত এগোলাম, তত শুকনো হতে থাকল বাতাস।
এই এলাকাকে ভালো বাংলায় ঊষর প্রান্তর বলা যেতে পারে। ‘ঊষর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নোনা বা ক্ষারযুক্ত মাটি। সেই মাটি অনুর্বর, মরুময়। নাইরোবি পেরিয়ে হাইওয়ে যখন মাচাকোস কাউন্টিতে ঢুকল, আক্ষরিক অর্থেই দু’পাশ অনুর্বর হয়ে গেল। তাতে কিছুই ফলে না। মাইলের পর মাইল শুধুই ফাঁকা— মানুষজন, ঘরবাড়ি, পশুপাখি, গাছপালা কিচ্ছু নেই। কেবল জমি পড়ে আছে। ভারতীয় হিসেবে বোধ হয় এমন দিগন্তের কল্পনা করাও কষ্টের। যদিও বোঝা গেল, চিন সরকার সেই ফাঁকা ভরাট করতে ভয়ানক উঠেপড়ে লেগেছে। ব্যবসায়ী দেশ, জমি খুঁজে মরছে, এত ফাঁকা জায়গা দেখে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে স্মার্ট সিটি ফেঁদে বসেছে। বিজ্ঞাপন পড়েছে, ২০৩০-এ নাকি দুবাই হবে ওই এলাকা।
ফাঁকা, ফাঁকা এবং ফাঁকার মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। দিগন্তরেখা অবধি স্পষ্ট দেখা যায়। খয়েরি মাটিতে কিছুটা দূরে দূরে কী সব যেন গোল গোল পাকিয়ে উঠছে। চালক পল কিমোথো জানান, ওগুলো ধুলোর ঝড়। ও রকম? কার্টুন নেটওয়ার্কের অ্যানিমেশন ছাড়াও বাস্তবের ঘূর্ণিঝড় এমন হয়?
কেনিয়ার একেবারে দক্ষিণতম প্রান্তে আমাদের গন্তব্য আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক। আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তথা আগ্নেয়গিরি কিলিমানজারোর পায়ের কাছে দুই দেশের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক সাভানা জঙ্গল।
সেই রাস্তায় শেষ গঞ্জ কিমানা। তার পর ১৭ কিলোমিটার গেলেই তানজানিয়া বর্ডার। প্রচুর মালপত্র এবং মানুষজন নিয়ে অনেক গাড়িই সে পথে যাচ্ছে। আমরা হাইওয়ে ছাড়লাম, ঢুকলাম কাঁচা রাস্তায়, জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গল মানেও বেশির ভাগটাই ফাঁকা, কিছু ঝোপঝাড় আর মাঝে মাঝে এক একটা বড়ো অ্যাকাশিয়া গাছ। রুক্ষ, শুকনো, এবড়ো খেবড়ো মাটিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পাথর। জানলাম, ছোটো বড়ো মাঝারি নানা আকারের পাথরগুলো যুগ যুগ ধরে মাউন্ট কিলিমানজারো থেকে লাভার স্রোতের সঙ্গে ভেসে এসেছে— আগ্নেয় পাথর। আলো পড়ে এসেছিল, তা-ও ঠাহর করা গেল সেই পাহাড়কে। ছোটোবেলা থেকে বইয়ে পড়েছি, আর ছবিতে দেখেছি যে একটা বিলকুল কালো পাহাড়ের মাথাটা সাদা বরফে ঝকঝক করছে। ঠিক সেটাই চোখের সামনে দেখলাম। গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল— স্বপ্ন সাকার হওয়ার বিমূঢ়তা।
এরই মাঝখানে ঘুরে বেড়ায় জিরাফ, জেব্রা। এ সব প্রাণী আসলে ও দেশে গাধা-টাধার মতোই রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, তাই আর অবাক লাগে না। সূর্যাস্ত হওয়ার মুখে পৌঁছলাম টেন্টেড ক্যাম্পে।
তাঁবুর মধ্যে খাট, মশারি, টেবিল সবই আছে। অ্যাটাচড বাথরুমও আছে। সামনে ছোটো বসার জায়গাও। আর ওখানে বসলে রাতদিন একটা জিনিসই দেখা যায়: কিলিমানজারো। ভোর থেকে মাঝরাত— রং বদলায়। রাতে শোয়ার সময় তাই তাঁবুর নেটটা ভালো করে আটকে মূল কাপড়টা তুলে দিলাম। খাটে শুয়ে শুয়ে ভোরের কিলিমানজারো দেখতে হবে যে! যথারীতি, পলের এত রোমাঞ্চ নেই। ওঁর আফশোস, হাতে আর ক’দিন সময় থাকলে আর এক বার কিলিমানজারো চড়ে আসা যেত। আর এক বার মানে অষ্টম বার! জানলাম, কিলিমানজারো ওয়াকিং পিক, অর্থাৎ হেঁটেই শৃঙ্গে আরোহণ করা যায়, মাউন্টেনিয়াররা নিশ্চিন্তে সামিট করেই থাকেন। মনে রাখা ভালো, যদিও গত ২০০ বছর ধরে এই আগ্নেয়গিরি ঘুমন্ত, আর শেষ বড়ো অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল ৩৬০,০০০ বছর আগে, কিন্তু সে যে জেগে উঠবে না, এই নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।
আসি জঙ্গলের কথায়। ভারতের জঙ্গলে বেড়াতে যারা অভ্যস্ত, প্রথমটায় আম্বোসেলিকে জঙ্গল হিসেবে মেনে নিতে তাদের কষ্টই হবে। এমনি একটা ঘাসজমিকে— আমরা যাকে মাঠ বলি— জঙ্গল বলে দেব? আবার ন্যাশনাল পার্ক? কিন্তু সেখানেই দলে দলে ঘুরে বেড়ায় আফ্রিকান হাতি বা বুশ এলিফ্যান্ট, মোষ বা কেপ বাফেলো, ইম্পালা হরিণ, সিংহ, চিতা, স্পটেড হায়না, মাসাই জিরাফ, গ্রান্ট’স জেব্রা, ব্লু উইল্ডবিস্ট। মাঝে মাঝে জলাভূমি। সেটাই ওদের পেয় জলের উৎস এবং গা ডুবিয়ে স্নান সারার জায়গা। আছে বিচিত্র পাখিও। আফ্রিকান জাকানা, গোলিয়াথ হেরন, গ্রে ক্রাউন্ড ক্রেন, হার্টলব’স বাস্টার্ড, রাফস চ্যাটারার প্রচুর চোখে পড়ে। এদের হাঁটাচলা, ঘোরাফেরা তো দেখাই যায়, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে বিচিত্র জলকেলি দেখার সুযোগও মেলে। বহু ক্ষণ এক জায়গায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা হাতি পরিবারের স্নানের দৃশ্য দেখেছিলাম। শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে কী সব কাণ্ডই যে করে তারা!
এই বিস্তৃত জঙ্গলের যেন কোনও শুরু নেই, কোনও শেষ নেই। একমাত্র অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া আর কারও পক্ষেই কোনও তাল পাওয়া সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট রুট ধরে ঘুরে বেড়ানো হলেও কিছু চিনতে পারা অসম্ভব। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে সবই এক রকম লাগে। তা ছাড়া, এত বেশি জায়গা আর সেই তুলনায় এত কম টুরিস্ট, যে এক বার জঙ্গলে ঢুকে পড়লে নিজেদের ছাড়া মানবসভ্যতার চিহ্ন সে ভাবে কিছুই চোখে পড়ে না। সাধে কি আর আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এত ফিকশন সৃষ্টি হয়েছে! অবশ্য যেখানে সেখানে যাওয়া যায় না। নিয়মের কড়াকড়ি আছে। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া গাড়ি থেকে নামা বারণ, কোনও ভাবেই প্রাণীদের বিরক্ত করা যায় না, রাস্তা দিয়েই চলতে হয়, মাঠের মধ্যে গাড়ি চালানো যায় না, এবং সবার আগে জীবজন্তুর দলকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক।
আম্বোসেলির সৌন্দর্য যেমন অপার, বিপদও অসীম। ৩৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই জঙ্গলের এক বিরাট অংশে জলস্তর বাড়ছে। সোয়্যাম্প বা জলাভূমিগুলোতে জল উঠছে, সঙ্গে বাড়ছে মাটির লবণাক্ততা। ফলে সেখানকার জীবজন্তুর ঘোর বিপদ। কিছু এলাকার প্রাণীরা অন্যত্র পালিয়েছে, বাকিরাও অনেকেই অপেক্ষায়। তবে মানুষ বোধ হয় বিপদ বোঝে দেরিতে। সবচেয়ে দামি যে খানকয়েক রিসর্ট জঙ্গলের একেবারে ভেতর আছে, তার একটা ডুবেছে। দেখে মনে হয় ভূতের আস্তানা। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কিছু কটেজ! মানুষের অবশ্য লোভের শেষ নেই। জঙ্গলের ভেতরে এয়ারস্ট্রিপও আছে। নাইরোবির ছোটো এয়ারপোর্ট উইলসন থেকে ছোটো বিমানে চেপে সোজা জঙ্গলের ভেতরে এসে নামা যায়।
দুপুরের দিকে জঙ্গলের ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যেই একটা টিলার ওপরে উঠলাম। ওখান থেকে বহু দূর দেখা যায়। যত দূর চোখ যায়, তত দূর। এর মাথায় উঠলে মালুম হয় পূর্ব আফ্রিকার আশ্চর্য নির্জনতা। সত্যিই মনে হয়, কোথায় যেন চলে এসেছি, আর ফিরতে পারব তো! সেই অনুভূতি একই সঙ্গে রোম্যান্টিক এবং ভয়ের। এই পরিবেশ তাই সুন্দরও, ভয়ঙ্করও। ঘাসজমি, জলাভূমি, কাঁটাঝোপ, জীবজন্তু, পাখপাখালি মিলিয়ে এক অদ্ভুত আদিমতা।
আম্বোসেলির প্রবল রুক্ষতা, শুষ্কতা সেই নিরিবিলি পরিবেশকে আরও ঘন করে তোলে। এ কারণে পাহাড়ি ছেলে পলের খুব একটা পছন্দের জায়গা নয় আম্বোসেলি। ওঁর অভিযোগ: ‘ভেরি ড্রাই’। তা ছাড়া, ধুলোর চোটে গাড়ির যা দশা হয়! জঙ্গল থেকে বেরিয়ে প্রথম কাজ এমালি শহরে আচ্ছা করে গাড়ি ধোয়া।
ফেরার পথে দেখলাম, টেন্টেড ক্যাম্পের কাছেই একটা মাসাই গ্রাম। বাওবাব গাছের নীচে মাটি আর খড় দিয়ে তৈরি ঘর। পোশাক আশাকও সাবেকি। এদের জীবনযাপনে আধুনিকতার ছোঁয়া কম, প্রায় নেই বললেও চলে। জীবন অতি কঠিন, নিঃসন্দেহে, তবে নিজেদের মতো করে এরা ফুর্তিতেই থাকে। এবং, জরুরি কথা, পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। অতিকায় পুঁজি আর দখলদার রাষ্ট্র পূর্ব আফ্রিকার প্রকৃতির ওপর বিষনজর না হেনে মাসাইদের জীবনযাপন একটু নিবিড়ভাবে দেখলে পারে। বাঁচতে শিখবে।
পূর্ব আফ্রিকা থেকে আমার পাওয়া অনেক, চাওয়া কেবল এটুকুই।