‘‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
ভক্তেরা লুটায় পথে করিছে প্রণাম!
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী!’’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুরী: ওড়িশার প্রাচীনতম রথযাত্রার উৎসব
পণ্ডিতেরা বলেন, হিন্দু ধর্মের আর পাঁচটা উৎসবের মতো রথযাত্রাও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির এক মিশ্রণে তৈরি এক লোকাচার। শাস্ত্রগ্রন্থ ও কিংবদন্তী অনুসারে বলা হয়ে বলা হয়, কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকার সমুদ্রীতীরে মৃতদেহ পোড়াবার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সত্কার কার্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ওই অর্ধদগ্ধ দেহাংশ সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূলে কলিঙ্গ রাজ্যে এসে পৌঁছয়। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী এক দল শবর তাদের নেতা বিশ্বাবসুর নেতৃত্বে গভীর জঙ্গলে মন্দির নির্মাণ করে ওই দেহাংশকে ‘নীলমাধব’ দেবতাজ্ঞানে পুজো করতে আরম্ভ করে। নীলমাধবের খ্যাতি শুনে প্রাচীন অবন্তী নগরীর বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তা হস্তগত করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। বিশ্বাবসুর কাছে পরাজিত ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন বিষ্ণুর প্রার্থনা আরম্ভ করেন।
ইন্দ্রদ্যুম্নর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁকে নির্দেশ দেন যে পুরীর সমুদ্রতীরে এক নিমকাষ্ঠ খণ্ড ভেসে আসবে তা থেকে যোগ্য কারিগর দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করে পুজো করতে হবে। যথা সময়ে পুরীর সমুদ্রতীরে চক্রতীর্থ অঞ্চলে একটি বড়ো নিমকাঠের গুঁড়ি ভেসে আসে। তা দিয়ে বিশ্বকর্মা ভাস্করের ছদ্মবেশে দেবতার বিগ্রহ তৈরি আরম্ভ করেন। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরির আগে রাজাকে শর্ত দেন যে, মূর্তি তৈরির জন্য একুশ দিন সময় দিতে হবে এবং মূর্তির নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ ওই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশ্বকর্মা সময় চাইলেও নির্মাণকার্যে দেরি দেখে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রানি গুণ্ডিচা অধৈর্য হয়ে পনের দিনের মাথায় দরজা খুলে ফেললে মূর্তি অসম্পূর্ণ রেখেই বিশ্বকর্মা অন্তর্হিত হন। তখন বিষ্ণুর নির্দেশে ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধসমাপ্ত জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়— আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যান (সেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’) এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। স্থানীয় ভাবে এটি মাসির বাড়ি যাওয়া নামে পরিচিত! রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও উল্টোরথ বলা হয়। ‘রথযাত্রা’ আবার পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাবেদীযাত্রা, নন্দীঘোষযাত্রা নামেও পরিচিত।
রথযাত্রায় তিন বিগ্রহের জন্য তৈরি হয় তিনটি পৃথক রথ। জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। এছাড়াও ওই রথকে চক্রধ্বজ বা গরুড়ধ্বজও বলা হয়। জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষ-এর উচ্চতা ৪৫ ফুট। এতে থাকে ১৮টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। পুরো রথটি লাল-হলুদ কাপড়ে মোড়া হয়। পীত বা হলুদ রঙের কাপড় কৃষ্ণের খুব পছন্দ বলে কৃষ্ণের অন্য নাম পীতাম্বর। এবং জগন্নাথ কৃষ্ণের এক রূপ বলে জগন্নাথের রথ মোড়া হয় লাল ও হলুদ কাপড় দিয়ে। শীর্ষে তালগাছের নিশান ওড়ে তাই বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। এর উচ্চতা ৪৪ ফুট। এতে আছে ১৬ টি চাকা, প্রতিটির ব্যস ৭ ফুট। এই রথ লাল-নীল কাপড়ে মোড়া থাকে। সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন। এর অর্থ হল অহংকে বধ করা। এই রথের উচ্চতা ৪৩ফুট, এতে আছে ১৪টি চাকা, যার প্রতিটির ব্যস ৭ফুট। ওই রথটি লাল-কালো কাপড়ে মোড়া থাকে। কালো শক্তি তথা দেবীমাতৃকার প্রতীক তাই ওই রং। রথের দিন প্রতিটি রথকে পঞ্চাশ গজ দড়িতে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাড়ি। সেখানে সাত দিন বিগ্রহ তিনটি থাকে আবার উল্টোরথের দিন একই ভাবে রথে তুলে মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উৎসব
দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রে না হলেও রথযাত্রাও বাংলার একটি অন্যতম বড়ো উৎসব। প্রাথমিক ভাবে ওড়িশার উৎসব হলেও শ্রীচৈতন্যর সূত্রে রথযাত্রা বঙ্গদেশেও যথেষ্ঠ জনপ্রিয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি সম্ভবত এসেছে শ্রীচৈতন্যর নীলাচল অর্থাৎ পুরী গমনের পরে। শ্রীচৈতন্যর নির্দেশে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। তবে ঠিক কবে কোথায় প্রথম রথটি টানা হয়েছিল তা বলা কঠিন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। তবে পুরীর মতো তিনটি নয়, একটি মাত্র রথেই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ তুলে রথযাত্রা হয়।
মাহেশের মন্দির
মাহেশের মন্দির
মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও রয়েছে তথ্যের অভাব। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়ে থাকে পুরীর দেবতা জগন্নাথ নাকি গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে মাহেশে এসে সেখানে থেকে যেতে মনস্থ করেন, এবং সেই অনুসারে সেখানে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয় ইতিহাস-পূর্বকালে। তবে ইতিহাস বলে, চৈতন্য সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সে মন্দির ভগ্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বড়োবাজারের মল্লিক পরিবারের নিমাইচরণ মল্লিকের দানে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির তৈরি হয়। শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে তাঁর ভক্ত কমলাকর পিপলাই আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানেও তাঁর বংশধরেরা ওই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
মাহেশের মন্দিরে বিগ্রহ
মাহেশের রথের সঙ্গেও কলকাতার সম্পর্ক গভীর। কথিত আছে মাহেশের প্রথম রথ নির্মাণ করিয়ে দেন জনৈক মোদক। কালের নিয়মে সে রথও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এক সময়ে কলকাতার শ্যামবাজার বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু একটি পঞ্চচূড় রথ তৈরি করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাহেশ জগন্নাথ মন্দির থেকে ‘মাসির বাড়ি’ পর্যন্ত রথ চলাচলের উপযোগী পাকা রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন, সেই সঙ্গে রাস্তার দু’পাশে অনেকটা করে জায়গাও কিনে মন্দিরকে দান করেন বড়ো আকারের রথের মেলা বসবার জন্য। পরে তিনি হুগলির কালেক্টরির দেওয়ানি পেয়ে জগন্নাথ মন্দিরের জন্য প্রচুর ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যান, যার আয় থেকে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হতে পারে। কৃষ্ণরামের তৈরি কাঠের রথ আগুনে পুড়ে গেলে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন বটে কিন্তু পুণ্যের লোভে জনৈক ব্যক্তি ওই রথের তলায় আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয়। গুরুপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র কালাচাঁদ নতুন একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন। সেটি জীর্ণ হলে কালাচাঁদের জ্যেষ্ঠ পৌত্র বিশ্বম্ভর একটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন। কিন্তু সেটিও আগুনে পুড়ে যায়। বার বার আগুনে পুড়ে রথ নষ্ট হওয়া আটকাতে বিশ্বম্ভরের ছোটো ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে ১২৫ টন ওজনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক বিশাল রথ নির্মাণ করিয়ে দেন সে যুগের অন্যতম নির্মাণ-স্থপতি সংস্থা ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানি’কে দিয়ে আর সে রথের নকশা করেন ভারতের প্রথম পাশ্চাত্যধারার স্থপতি নীলমণি মিত্র।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সম্প্রীতির কাহিনিও। সপ্তগ্রামের বোড়ো পরগনার জায়গিরদার নবাব খাঁনে আলি খাঁন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করবার সময় এক বার ঝড়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। মন্দিরের তত্কালীন সেবায়েত রাজীব অধিকারীর আপ্যায়ণনে সন্তুষ্ট হয়ে নবাব খাঁনে আলি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অঞ্চলের জগন্নাথপুরকে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের নামে লিখিত দলিলের মাধ্যমে নিষ্কর দেবোত্তর করে দেন। পরে মাহেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে এলে কোম্পানিও সেই দলিলকে মান্যতা দিয়ে ওই পরগনা নিষ্কর ঘোষণা করে।
মাহেশের রথ
বিত্তবান ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিদের সহায়তায় এক সময় মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্সবে পরিণত হয়েছিল। কালের প্রভাবে আজ সেই শ্রেষ্ঠত্ব হয়ত বজায় নেই তবে এখনও বাংলার এই প্রাচীনতম রথযাত্রার উৎসব দেখতে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তার কৃতিত্ব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত কমলাকর পিপলাইয়ের উত্তরপুরুষ অধিকারীরা এবং রথের ব্যবস্থাপক শ্যামবাজার বসু পরিবারের সদস্যদেরই প্রাপ্য।