রহস্যময় ছবিমুড়া

By : সোমক মজুমদার | : 08 August, 2021
রহস্যময় ছবিমুড়া

ত্রিপুরা ভ্রমণে অধিকাংশ পর্যটক ঊনকোটি যান শৈব ভাস্কর্য দেখতেঊনকোটি আগরতলা থেকে প্রায় ১৮০ কিমি দূরযাওয়া আসা এবং দেখা সব মিলিয়ে অন্তত তিন দিনতুলনায় আরেকটি স্বল্প আলোচিত প্রস্তর ভাস্কর্য অনাদরে অবহেলায় কালের শাসানি ভোগ করছেনাম তার ছবিমুড়াআরেক নাম দেওতামুড়াউদয়পুর নগরী থেকে মাত্র ৩৫ কিমি দূরে জল জঙ্গলে ঘেরা এক গা ছমছমে পরিবেশে এই ভাস্কর্য কীর্তি লুকিয়ে আছে লোক চক্ষুর অন্তরালেঅল্প সময়ে ত্রিপুরার প্রত্নসম্পদ সম্পর্কে জানতে হলে ছবিমুড়া এক অবশ্য গন্তব্য। 

         স্থানীয় ভাষায় মুড়া মানে পাহাড় ছবিমুড়া দক্ষিণ ত্রিপুরায় গোমতী নদীর দুই তীর বরাবরনদীপথেই যেতে হবেত্রিপুরা আসার আগে যতটুকু পড়াশুনো করেছি তাতে বুঝলাম ছবিমুড়ার বর্ণনাটা কিঞ্চিত ভাষা ভাষাযাওয়া যায় এটুকু বোঝা গেছেকিন্তু কিভাবে আর কোন পথে তা কোথাও বিশদ বলা নেইতবে আগরতলার ট্যুরিজম্ ডেভেলপমেন্ট প্রধান অসিতবাবু জানিয়েছিলেন ছবিমুড়া যাওয়াটা খুব একটা সমস্যা নয়সেই আশাতেই পথ চলাআর ব্যাপারটা যে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই 

         উদয়পুর থেকে ৩০ কিমি গেলে অমরপুর রাস্তাটা ঘাট রোডমানে পাহাড়ের বুকে ক্রমাগত এঁকেবেঁকে চলেছেদুপাশে জঙ্গলদুরে হালকা সবুজ পাহাড়ের সারিপাহাড়ি পথে মোচড় খেতে খেতে একসময় অমরপুর পৌঁছে একটা ছোট্ট চা পানের বিরতিসঙ্গে টা হিসেবে বড় আকারের মিষ্টি যার নাম লালমোহন! পান্তুয়া আর গোলাপজামের একটা মিশ্রণ বলা যায়

         শহর ছাড়ালেই এক প্রত্যন্ত গ্রামতার শেষ মাথায় গোমতী নদীঅমরপুর থেকে গোমতী নদী পর্যন্ত রাস্তাটা বন্ধু নয়বরং বন্ধুরপুরোটাই ইট বিছোনোকোথাও কোথাও সমতল হলেও বেশিটাই এবড়ো খেবড়ো দুধারে টিনের ছাদের বাড়িশস্যক্ষেতপ্রচুর হাঁস মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছেনারকেল আর বাঁশ গাছ ঘেরা পুকুরএসব দেখতে দেখতে যখন আধঘন্টারও বেশি অতিক্রান্ত তখন বাধ্য হয়ে পথচলতি মানুষদের প্রশ্ন করতেই হয়, ছবিমুড়া কতদূর গো? এটা কি ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি? তারা সহাস্যে জবাব দিল, হ্যাঁ একদম ঠিক রাস্তাআরেকটু যানদেখবেন পথ শেষে জেটি ঘাট। চার পাঁচজন বসে আছেওখান থেকে নৌকোয় যেতে হবে

         এরপরেই রাস্তার ডানপাশে দেখা দিল গোমতীশীর্ণতোয়াআরেকটু এগোতেই - হ্যাঁ জনা ছয়েক মানুষ বসেপর্যটক দেখে উঠে দাঁড়ালএরা সব নৌকোর মাঝিঅবশ্য নৌকো না বলে মোটরবোট বলাই ভাল। এই বোট চেপেই পাড়ি দেব ছবিমুড়ার দেশে।  

বেগুনক্ষেতের পাশ দিয়ে বস্তা বিছোনো কাদা মাটির সিঁড়ি সাবধানে পা ফেলে নামতে হল নদীগর্ভে তক্তা পেতে বোটে ওঠার ব্যবস্থালাল রঙা দশ সীটের মোটর বোট সবাইকে নিয়ে চলতে শুরু করল সঙ্গে চালক আর তার সহকারী দুজনেরই বয়স কুড়ি বাইশ হবে

         গোমতীর জল যথেষ্ট ঘোলাআর প্রচুর ফেনাদুপাশে ছোট ছোট গাছের বনযত মোটরবোট এগোচ্ছে ততই গাছের পরিমাণ বাড়ছে একটু পরেই অরণ্যের ঘনত্ব অনেকটা বেড়ে গেল বেশ নির্জন একটা গা ছমছমে ব্যাপার মানুষজন তো দূরের কথা একটা পাখির অবধি দেখা নেই শোনা যায় এই জঙ্গলে হুলুক গিবনদের বাসনদীপথে চলতে চলতে তাদের উল্লুক ডাক শোনা যায়তবে সে সব ভাগ্যের ব্যাপার

         ক্রমশ দুপাশে উঁচু খাড়া পাথরের পাহাড় দেখা দিলপাথরের গায়ে বন জঙ্গলমাঝখানে নদীর গর্জ ঠিক যেন অ্যামাজন অরণ্য, ভারতীয় রূপেদুপাশে গাছের ডাল নুয়ে নদীর জল ছুঁয়েছেএই পথে কিছুটা যাবার পর বোটের গতি কমে এল। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করতেই নিস্তব্ধ চরাচরে শুধুই জলস্রোতের শব্দ চালকের প্রসারিত হাত সামনের দিকেসামনের পাহাড়টির গায়ে নদীর জল থেকে পাঁচ-ছ ফুট ওপরে এক সারি চওড়া মূর্তি ভাস্কর্য ছবিমুড়া   

এতক্ষণে বোঝা গেল ছবিমুড়াকে কেন দেওতামুড়া বলা হয় পাথরের গায়ে পাশাপাশি খোদাই করা বিভিন্ন দেবমূর্তিমাঝখানে ব্রহ্মা দুপাশে আরো দুটি পদ্মাসনে অবয়ব একটি সম্ভবত তারাদেবী অন্যটা কালের প্রভাবে ক্ষয়ীভূতএকটু ওপরের দিকে পাশাপাশি দশাবতার মূর্তিতাদের বেশিটাই আগাছা ঢাকাওপরে শ্যাওলা জমেছেকোনটা কি বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য

         বোট আবার এগিয়ে চলল সামনের দিকেএকঘেয়ে কটকট আওয়াজজঙ্গল আরো ঘন হচ্ছেদুপাশের পাহাড় আরো খাড়াইকোন জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেইতবে গোমতীর জলে তেমন স্রোত নেইআকাশও পরিস্কার ফলে নদীর কোনো বাঁকে রোদ তো আবার পরক্ষণেই ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক এমনি ভাবে চলতে চলতে আবার বোটের গতি রুদ্ধ হলআর পাহাড়ের গায়ে আগাছার ফাঁকে দেখা গেল এক মস্ত ভাস্কর্য প্যানেলমহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিচারপাশে কলকা নকশা। 

          সবাই বিস্ময়ে হতবাক! এমন এক ভাস্কর্যকীর্তি অরণ্যের গহনে গাছপালায় ঢাকা পড়ে আছে? ওই তো পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে দেবীর উড়ন্ত কেশ রাশিপদতলে সিংহল্যাজটি উঁচু হয়ে আছেঅসুর টেনে বার করছে তরোয়াল দেবীর সাতটি হাত বেশ স্পষ্টতাতে অস্ত্রবাকিরা একটু ক্ষয়ীভূত

         সত্যি কথা বলতে কি গোমতীর পাড়ে এমন ঘন জঙ্গল ঢাকা পাহাড় আর তার গায়ে এই খোদাই শিল্প, বেশ রহস্যময় কারা, কোন সময়ে এখানে, সবার চোখের আড়ালে এই শিল্প রচনা করেছিলেন তা পুরোটাই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সবথেকে বড় প্রশ্ন, কেন? কিসের এত গোপনীয়তা? গবেষকরা বলেছেন এই ভাস্কর্য পাঁচশ বছরের পুরোনোকিন্তু গ্র্যানাইট পাথরের গায়ে এই কারুকাজ যে পরিমাণে ক্ষয়িত তা মাত্র পাঁচশ বছরে হয়েছে ভাবনাটা ঠিক সন্তুষ্টি জনক নয়আর এত দূর্গম স্থান নির্বাচনে কারণ কি? পাঁচ ছ'শ বছর আগে কিভাবে আসত মানুষ এখানে? নৌকো ছাড়া আর নিশ্চয়ই কোন উপায় ছিল না!

তবে একটা জিনিস হতে পারে, একদা এই জায়গাটিতে হয়ত নিয়মিত মানুষের যাতায়াত ছিলপরে ধর্ম হয়ত অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল ইসলামিক রাষ্ট্র শক্তি বা বৌদ্ধ প্রভাবেআর তখনি এমন নির্জন দুরুহ স্থানে দেবতা মূর্তি বানিয়ে গোপনে তার পুজো করা হততবে পাহাড়ের গায়ে এমন দূর্গামূর্তি বানানোটাও একটা অভূতপূর্ব ব্যাপারখালি হাতে এই উচ্চতায় পৌঁছানো তো, এককথায় অসম্ভবহয়ত কোন বিরাট বড় নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে ভাস্কর এই কাজ করেছিলেন! তবে এ সবই তো আমাদের কল্পনার ভাবনা

         প্রত্নতাত্ত্বিক হিসাবে দেওতামুড়ায় মোট ছবি সংখ্যা ৩৮এর মধ্যে মহিষাসুর মর্দিনী ছাড়া আর আছে শিব, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক এবং দেবী শক্তিক্রমাগত পাহাড়ের মাথা থেকে জল পড়ার ফলে ভাস্কর্য আরো ক্ষয়ে যাচ্ছেস্বভাবতই পুরাতত্ত্ব বিভাগ বেশ উদাসীনপরিকাঠামোর অভাব সর্বত্রতাই সাইন বোর্ড দেখে ছবিমুড়া পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হয়সরকার অবশ্য সম্প্রতি দুটি মোটর বোট দেওয়ায় নদীপথে যাতায়াত সহজতর হয়েছেআগে তো বৈঠা বাওয়া নৌকায় যেতে হতএখন মোটর বোটের সুবাদে মোটামুটি দুঘন্টায় ছবিমুড়া জলপথে ঘুরে আসা গেল

         বিকেল তিনটে নাগাদ আবার বোট এসে ভিড়ল ঘাটেএই জলযাত্রা আজীবন মনে রাখার মতশহরের কোলাহল থেকে কত দূরে গভীর অরণ্য ঘেরা গোমতী নদীতার তীর বরাবর প্রাচীন মানুষের হাতে তৈরি শিল্পকলাত্রিপুরা তথা ভারতের এক অনন্য সম্পদএই যে বোট চালক রিয়াং উপজাতীয় ছেলেটি কত সহজ সরল। এখন ফেরার সময় তার দায়িত্ব কমকারণ সে পর্যটকদের ইতিমধ্যে ভারতের এক অত্যাশ্চর্য দ্রষ্টব্য দেখাতে সক্ষম হয়েছেতাই সে সহকারীর হাতে হাল ছেড়ে খুলে ফেলল খাবারের পাত্রসামান্য ঘুরে বসে বেগুন-শুঁটকির চাটনি দিয়ে ভাত খেয়ে নিল বোটেইকারণ যাত্রীদের নামিয়েই সে আবার রওনা দেবে অন্য দিকে অন্য কাজে

         ছবিমুড়া অবশ্য চিরকালই কূহেলিকাময় থাকবে

লেখক পরিচিতি

সোমক মজুমদার
সোমক মজুমদার
পেশা যাই হোক, নেশা ভ্রমণ আর ছবি তোলা। প্রাচীন মন্দির, পাখি, স্টিল লাইফ এমনকি সুদৃশ্য খাবার – কোন কিছুই যার লেন্সের নজর থেকে রেহাই পায় না। স্বপ্ন দেখেন বিরিয়ানি আর বেড়ানোর।

মহেশ্বরের উপকন্ঠে

13 April, 2021 | : সোমক মজুমদার

রহস্যময় ছবিমুড়া

08 August, 2021 | : সোমক মজুমদার

রহস্যময় ছবিমুড়া

08 August, 2021 | : সোমক মজুমদার

মহেশ্বরের উপকন্ঠে

13 April, 2021 | : সোমক মজুমদার