মহেশ্বরের উপকন্ঠে

By : সোমক মজুমদার | : 13 April, 2021
মহেশ্বরের উপকন্ঠে

নর্মদা। মধ্যভারতের প্রধান স্রোতস্বিনী। সবুজ নীল জলে টইটুম্বুর। পুরাকালে যার নাম ছিল রেওয়া। অমরকন্টক মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সেই গুজরাটের খাম্বাত্ উপসাগর হয়ে মিশেছে আরব সাগরে। তেরশো কিলোমিটারেরও বেশি এই যাত্রা পথে কতটাই না রোমাঞ্চ। কত নগর উপনগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নর্মদা কত ঘটনা, কত ইতিহাসেরই না সাক্ষী! আবার এই নদীই আপাত ভাবে ভারতকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। ভৌগোলিকভাবে এর ওপর ভাগটি উত্তর ভারত, আর নীচটি দক্ষিণ ভারত। তাই সবদিক থেকেই নর্মদার গুরুত্ব মধ্য ভারতে অপরিসীম।নর্মদা তীরে মহেশ্বর ঘাট। ইন্দোর থেকে আড়াই ঘন্টার পথ। মসৃণ আগ্রা-মুম্বই জাতীয় সড়ক। দুপাশে গম, ভুট্টা আর যবের ক্ষেত। কিছুটা পেকেছে, বাকিটা সময়ের অপেক্ষা। অনেকটা সমতলভূমির ওপর দিয়ে চলার পর শুরু হল পার্বত্য মালভূমি অঞ্চল। ঘাট রোড। এদিককার ঘাট মানে পাহাড়ি পথ একটু অন্যরকম। দুপাশে মাঝারি উচ্চতার পাহাড়-টিলা, মাঝখান দিয়ে পাথর কেটে রাস্তা বার করা হয়েছে।

মধ্যপ্রদেশের খড়গাঁও জেলায় এই মহেশ্বর। উচ্চতা মাত্র ৫০০ ফুট। তিরিশ হাজার লোকের বাস। পুরাণ মতে রাক্ষসরাজ রাবণ এখান দিয়ে যাচ্ছিলেন পুষ্পকরথ চেপে। নেমে পড়েছিলেন শিবপুজো করতে। সেই থেকে এটি একটি শিবতীর্থ। বিভিন্ন হাতে শাসন হতে হতে শেষ পর্যন্ত আঠারো শতকে মরাঠি রাজা হোলকারদের অধীনে আসে। রাজা মলহার রাও হোলকার ছিলেন প্রথম স্থাপক-শাসক। তাঁর ছেলে যুদ্ধে মারা যান। তখন পুত্রবধু অহল্যা বাঈ সহমরণে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা দিলেন স্বয়ং শ্বশুর মলহার রাও। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর পুত্রবধুটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং সাহসী। তাকে কোনভাবেই হারানো যাবে না। রাজ্যের স্বার্থে একে দরকার।  তাই সামাজিক প্রথাকে ভেঙে  অহল্যাকে আত্মাহুতি দিতে দিলেন না। শুধু তাই নয়, অহল্যাকে ঢুকিয়ে দিলেন রাজকর্মে। তাকে সঙ্গে নিয়ে ক্রমে ইন্দোর এবং অন্যান্য জায়গায় শাসন চালাতে লাগলেন। মহেশ্বর ছিল হোলকারদের প্রথম রাজধানী।  

মলহার রাও মারা যাবার মালেরাও হোলকার মাত্র ন মাস রাজত্ব করেছিলেন। তারপর তৃতীয় শাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন রানি অহল্যা বাঈ হোলকার। এই মহেশ্বর থেকেই তিনি আঠাশ বছর দাপটের সঙ্গে  রাজত্ব করেছিলেন।

মহেশ্বরের মূল আকর্ষণ হল বিরাট এক দূর্গ। ১৭শ-১৮শ শতকে তৈরি এই দূর্গ ছিল একটি ঘন বসতি পূর্ণ সমৃদ্ধ নগর, স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই ধরনের যেকোন ফোর্টই হল একটা টাউনশিপ। তার মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার জায়গা, গ্রাম, বাজার, মন্দির সবই থাকত। এই দুর্গে ঢুকলেই সেরকমই একটা অনুভব হয়। একটা বিরাট লোকালয়, দুর্ভেদ্য প্রাচীর ঘেরা। ঢোকার দরজা পাঁচটি। প্রথম দ্রষ্টব্য, মহেশ্বর রাজওয়াড়া বা রাজবাড়া।

রাজবাড়া মানে রাজার বাড়ি। এই প্রাসাদটি রানিমা বানিয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রথম দেখাতে মনে হয় কোন বড় মাপের বসত বাড়ি। ঠিক প্রাসাদোচিত জমক বা বৈভব কিন্তু এখানে অনুপস্থিত। তার একটা বড় কারণ, রাণী ছিলেন সহজ প্রাণ মানুষ। জীবনে যতটা সময় স্বামীর সঙ্গে ছিলেন তার তিনগুণ সময় বিধবা রূপে কাটিয়েছেন। তাই, বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারিণী এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও রানি ছিলেন মাটির কাছাকাছি মানুষ। এই প্রাসাদটিকে তাঁর কাছে ছিল এক পবিত্র স্থান এবং অনেকটা দেবগৃহ তুল্য।

বিরাট প্রশস্ত প্রাঙ্গণ আর গাছপালা শোভিত বাড়ি। সারি বারান্দায় পরপর সাজানো রয়েছে হোলকার রাজাদের ব্যবহৃত তরবারি অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল, পালকি, বসার বড় চৌকি। ইটের দেওয়াল এবং ছাদ একদিকের বারান্দা দরবারের মত করে সাজানো। কাঠের। এই ধরনের স্থাপত্য দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় রাজাদের প্রাসাদে দেখা যায়। খুব বেশি করে মনে পড়ছিল কুর্গের শিকার প্রাসাদ নালকনাড়ের কথা।

 উলটো দিকের বিরাট কাঠের দরজা পেরিয়ে সারি সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। এটা দূর্গের বাইরের দিক। এখানে একটা মস্ত মুক্ত প্রাঙ্গন রয়েছে। তার একদিকে বিরাটাকার অহল্যেশ্বর শিবের মন্দির। এই মন্দিরটির স্থাপত্য অনেকটাই বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দিরের মত। মহারানী তো সেই মন্দিরেরও পুর্ননির্মাতা। ফলে গঠনটা তো একরকম হবেই। পঁয়ত্রিশ বছর এবং দেড় কোটি টাকা লেগেছিল এই মন্দির বানাতে। তবে প্রথাগত মধ্যপ্রদেশীয় মন্দিরের মতো নয় এই স্থাপত্য। বেশ খানিকটা ইন্দো-সারসিনিক প্রভাব আছে। তিনদিকেই মুখমন্ডপ আছে। একটু সামনের দিকে বাড়ানো। অনেকটা বারান্দার মতো। তিনদিকে ঝারোখার মত প্রক্ষিপ্ত বারান্দা আর ওপরে ঝাঁপ দিতে উদ্যত সিংহের মূর্তি আছে।

উলটো দিকের ছত্রিটি বিঠোজীর—  বিঠোজী রাও হোলকার। বিঠোবা নামে বেশি পরিচিত। যাকে ১৮০১ সালে, পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর সেনাপতি বালাজি কুঞ্জীর আদেশে হাতি দিয়ে পদপিষ্ট করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর থেকেই হোলকারদের সঙ্গে পেশোয়াদের সরাসরি সংঘাতের শুরু। ছত্রিটি ভারি সুন্দর। শীর্ষভাগটি একটি উপুড় করা বিরাট সূর্যমুখী ফুলের মত। খিলান আকৃতির দরজা জানলা। সর্বাঙ্গে নকশা কাজ। সব মিলিয়ে মধ্যযুগের একটি জমকালো স্থাপত্য নিদর্শন।  

এবার বিরাট সিংদরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম দূর্গের দক্ষিণ দিকে। এই দিকটাতেই বিখ্যাত মহেশ্বর ঘাট। বিরাট এলাকা। সামনে নীলচে সবুজ জলে ভরা নর্মদা। ঘাটে বাঁধা আছে সারি সারি মোটরবোট। মহেশ্বর ঘাটের রং ও রূপ দেখার মত। বিভিন্ন রঙের মোটরবোট সবুজ জলে ভাসছে। নানা বর্ণের কাপড় মেলা হয়েছে শুকিয়ে নেবার জন্য। আর বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ত। কেউ বা ঘুরতে এসেছেন, আবার কেউ পুজোপাঠে মগ্ন। সব মিলিয়ে একটা অসামান্য রংবহুল ব্যাপার। কিন্তু মানতেই হবে নর্মদার এই ঘাটে সামান্যতম নোংরাও নেই। আসলে গোটা মধ্যপ্রদেশ জুড়েই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখার মত।

 নৌবিহারে ভেসে পড়ি। দূরে সরে যেতেই পুরো মহেশ্বর ঘাটটা চোখের সামনে ফুটে উঠল। এ যেন ওয়াইড অ্যাঙ্গল্ ছবি। দূর্গ, পিরামিডাকৃতি সিঁড়ির সারি, এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিস্তৃত প্রাকার—  সবই যেন সিনেমার মত। মাঝে গর্বিত মস্তক অহল্যা বাঈয়ের মন্দির।

ক্রমে ধূসর হয়ে গেল ঘাটের ছবি। বোট এসে ভিড়ল নদীর চরায়। নর্মদার বুকে জেগে ওঠা এক টুকরো সবুজ দ্বীপ। তার ওপর বাণেশ্বর শিব মন্দির। এই কি সেই রাবণ রাজার শিব মন্দির? নাহ্, সে তো কবেই ধুয়ে মেছে গেছিল। এ মন্দির আরেকটু পরের। সম্ভবত নবম-দশম শতাব্দীর। পাথরের রেখ দেউল স্থাপত্য, হিসেব অনুসারে ওই সময়ের কথাই সমর্থন করে। ঘন বর্ষায় জল বাড়লে এই দেবালয় চলে যায় পাতালে। মানে জলের তলায়। আবার জল কমলে দৃশ্যমান হয়। বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার।  

মন্দির ছাড়া আর যে জিনিসটি এখানকার বিখ্যাত তা হল মহেশ্বরী শাড়ি। সূতির শাড়ি, তাতে জরির কাজ। এই শাড়ির প্রবর্তক স্বয়ং রাজমাতা অহল্যা বাঈ। ১৭ শতকে রানির আমন্ত্রণে মান্ডু থেকে তন্তুবায় কারিগররা এখানে এসে শাড়ি বানানো শুরু করেন। এই কাপড় এক সময় পেশোয়াদের রাজকীয় ভেট হিসেবে পাঠানো হত।

মহেশ্বরী শাড়ি মূলত চারটি রঙে হয়। ময়ূরকন্ঠী নীল, হলুদ, জংলা সবুজ এবং লাল। শাড়ির পাড়ে পাঁচ-ছ রকমের নকশা দেখা যায়—  লহর (ঢেউ), নর্মদা (নদী), রুই ফুল (তুলো ফুল), চাটাই (মাদুর), ইট এবং হিরে। খাঁটি মহেশ্বরী শাড়িটি হবে ন গজ লম্বা এবং দুদিকেই আঁচল থাকবে। শোনা যায়, দেবী অহল্যাবাঈ এই শাড়ি বানানোর জন্য ইজিপ্ট থেকে তুলো এবং ফ্রান্সের লয়েন থেকে জরি আনাতেন!     

মধ্যপ্রদেশ পর্যটন বিভাগের অতিথি আবাসটি কিলোমিটার খানেক দূরে। অপরিসর রাস্তা দিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। আহা, কি অপূর্ব! সামনেই বিস্তীর্ণ নর্মদা। কলকল করে বয়ে চলেছে। দূরে দেখা যাচ্ছে বাণেশ্বর মন্দির। দুপুরের সূর্যালোকে জলটা একদম চকচক করছে। যেন হীরকদ্যুতি। যেকোন নদীই মানুষের কাছে পবিত্র, মানবসভ্যতায় তার অপরিসীম অবদানের জন্য। আর নর্মদার পবিত্রতা যেন আরো অনেক বেশি—  তাই তো এই নগর মধ্যভারতের বারাণসী তুল্য।

ভোজনান্তে নর্মদার তীরে ঝিরঝিরে বাতাসে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। রোদের তেজ ক্রমশ কমে আসছে। এবার উঠতে হবে। এখান থেকেই শুরু হবে এই ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব—  মান্ডু। এক নদীতীরের দূর্গ শহর থেকে উত্তরণ ঘটবে প্রাচীন মালোয়ার মালভূমিতে, যেখানে রোমান্স আর ইতিহাস হাত ধরাধরি করে আজও হাঁটছে। সে গল্প আরেক দিন হবে।

লেখক পরিচিতি

সোমক মজুমদার
সোমক মজুমদার
পেশা যাই হোক, নেশা ভ্রমণ আর ছবি তোলা। প্রাচীন মন্দির, পাখি, স্টিল লাইফ এমনকি সুদৃশ্য খাবার – কোন কিছুই যার লেন্সের নজর থেকে রেহাই পায় না। স্বপ্ন দেখেন বিরিয়ানি আর বেড়ানোর।

মহেশ্বরের উপকন্ঠে

13 April, 2021 | : সোমক মজুমদার

রহস্যময় ছবিমুড়া

08 August, 2021 | : সোমক মজুমদার

রহস্যময় ছবিমুড়া

08 August, 2021 | : সোমক মজুমদার

মহেশ্বরের উপকন্ঠে

13 April, 2021 | : সোমক মজুমদার