নাগাল্যান্ড ও মণিপুর রাজ্যের সীমান্তে জুকু (Dzukou) ভ্যালি এক মনোরম সৌন্দর্যৈর ডালি নিয়ে অবস্থিত। প্রায় সব ঋতুতেই বিভিন্ন ফুলের সমারোহ। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ২৪৫২ মিটার। পিছনেই নাগাল্যান্ডের জাফু পর্বত। দুষ্প্রাপ্য জুকু লিলি এখানে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।
জুকু কথাটি আংগামি নাগাদের (ভিস্যেমা উপভাষা) ভাষায় হল 'আত্মা'হীন ও 'নিস্তেজ' (Soulless & dull)। কারণ ভিস্যেমাদের পুর্বপুরুষেরা এখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে বিফল হন। ফসল ফলানোর জন্য আবহাওয়া ছিল বিরূপ আর ঠান্ডার প্রকোপ। জুকু ভ্যালির অধিকাংশটাই মণিপুর রাজ্যের। এই নিয়ে টানাপড়েন চলছে নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের মধ্যে।
দুভাবে জুকু ভ্যালি ওঠা যায়। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে মোটামুটি ১৬ কিঃমিঃ দূরে জাখামা দিয়ে অথবা ২৩ কিঃমিঃ দূরে ভিস্যেমা দিয়ে। জাখামা দিয়ে উঠলে রাস্তা একটু কম হয়, প্রায় ১২-১৪ কিঃমিঃ। কিন্তু পুরোটাই চড়াই। খাঁড়া পাথরের সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। তারপর প্রায় ৩ কিঃমিঃ সমতল রাস্তা হেঁটে ট্রেকারস হাট। আর ভিস্যেমা গ্রাম থেকে রাস্তাটা কিছুটা চড়াই, প্রায় ৮ কিঃমিঃ মত। তারপর প্রায় আরও ৮-৯ কিঃমিঃ ভ্যালির অধিকাংশটাই প্রায় সমতল ভূমির উপর দিয়ে হেঁটে ট্রেকারস হাট।
২০১৭র জুন মাসের ২ তারিখে আমরা পাঁচ জন কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম জুকুর উদ্দেশ্যে। প্লেনে ডিমাপুর আর তারপর গাড়িতে কোহিমা। কোহিমাতে কয়েকদিন কাটিয়ে ৭ই জুন সকালে একটা গাড়ি ভাড়া করে জাখামাতে এলাম ট্রেকিং শুরু করব বলে।
সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। বাংলাদেশে নিম্নচাপের জন্য এখানেও আকাশের মুখ ভার। সকাল ৭টায় গাড়ি থেকে নামতে নামতেই খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওর মধ্যেই রেনকোট, প্লাস্টিকে নিজেদের মুড়ে নিয়ে চড়াই ভাঙ্গতে শুরু করলাম।
প্রথমে বেশ কিছুটা রাস্তা ধীরে-ধীরে ওঠা। তারপর শুরু হলো বড়-বড় পাথরের ধাপ। বৃষ্টি অঝোর ধারায় ঝরে চলেছে আর আমরা পাথরের ধাপ ধরে ধরে উঠেই চলেছি। কোথাও একটু দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। প্রায় 4 কিঃমিঃ মতো চড়াই ভাঙ্গার পর একটা কাঠের তৈরি বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা দেখা গেল। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুটো কাঠের গুঁড়ি রাখা আছে বসার জন্য। আরও ভিতরে একটা ভাঙ্গা দরজার পিছনে একটা ঘরে একটা উঁচু নিচু কাঠের তক্তাপোষ। সাপখোপের ভয়ে বসলাম না। দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে, কিছু শুকনো খাবার মুখে ফেলে আবার চড়াই ভাঙ্গা শুরু হল। বুড়ো হাড়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। দলে আমি আর শ্যামল চক্রবর্তী দুই বুড়ো। কিন্তু তরুণ হাঁটুদের তো বুঝতে দেওয়া যাবে না। হাঁপাতে হাঁপাতে পিছনে পিছনে উঠতে লাগলাম। পিছনে অর্ণব আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। হঠাৎ রাস্তার উপর তীব্র শ্রোতের ঝর্না। রাস্তার এপার ওপার মোটা নাইলনের দড়ি লাগিয়ে রাখা আছে। এবার পার হওয়ার জন্য তরুণ হাঁটুদের সাহায্য নিতেই হল।
আরও ৪-৫ কিঃমিঃ ওঠার পর একটা টিনের আচ্ছাদন দেওয়া জায়গা পাওয়া গেল। এখানে সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা করা আছে। চারপাশ খোলা থাকায় বেশ আলো-হাওয়া আছে। সবে আরাম করে বসেছি, দলের তরুণ ডাক্তার শুভ বলে উঠলো "কাকু বসবেন না। পায়ে ল্যাকটিক এসিড জমবে। এরপর হাঁটতে পারবেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিন।" সুতরাং ঘোড়াদের মত বিশ্রাম নিতে হল। আধঘন্টা মত বিশ্রাম নিয়ে আবার চড়াই ভাঙ্গা শুরু হল। শুভ আর উমাশংকর আগে আগে চলেছে আর বলে চলেছে কাকু প্রায় এসে গেছি আর একটু। এই করে করে আরও ৫-৬ কিঃমিঃ হেঁটে একটা পাথরের ধাপে উঠে এলাম। হঠাৎ একঝলক ঠান্ডা বাতাস ঘর্মাক্ত শরীরটা জুড়িয়ে দিল। শুভর ডাক শুনতে পেলাম "কাকু এসে গেছি"। হাঁচরপাঁচর করে উপরে উঠে এলাম জুকু উপত্যকা দেখার আশায়। শুভর মুখে এর অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা অনেক শুনেছি। ওর এবার নিয়ে তৃতীয়বার হল। কিন্তু কোথায় কী? ঘন কুয়াশায় দশ হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। তীব্র বেগে ঠান্ডা হাওয়া আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এইবার ধীরে ধীরে প্রায় সমতল ভূমির মধ্যে দিয়ে কিছুটা নামা।
প্রায় ৩ কিঃমিঃ হেঁটে ট্রেকারস হাট। হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম পুরো ভ্যালিটাই ছোট ছোট সরু বাঁশঝাড়ে ভর্তি। আরাম করে পুরো রাস্তা হেঁটে চলে এলাম ট্রেকার্স হাটে। ভিস্যেমা দুঃখ রয়ে গেল মেঘ বৃষ্টির জন্য ভ্যালির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারলাম না। দুদিন ছিলাম ভ্যালিতে। নিম্নচাপের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু দেখতে পেলাম তাতে আবার যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে গেল। ফেরার সময় ভিস্যেমা গ্রামের রাস্তা ধরে ফিরে এলাম। রাস্তা তুলনামূলক কম কষ্টকর।
কিছু তথ্য: কলকাতা থেকে সরাসরি ডিমাপুর ফ্লাইট অথবা হাওড়া থেকে ট্রেনে ডিমাপুর। কামরূপ এক্সপ্রেস বিকেল ৫টা ৩৫মিঃ ছেড়ে পরদিন রাতে ৯টা ৩৫ নাগাদ পৌঁছায় ডিমাপুর। ডিমাপুর থেকে ভাড়া গাড়িতে বা শেয়ারে, নাগাল্যান্ড স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাসে মোটামুটি ৭৫ কিঃমিঃ দূরে (ঘন্টা চারেক) কোহিমা। কোহিমা থেকে মোটামুটি ১৬ কিঃমিঃ দূরে জাখামা আর ২৩ কিমি দূরে ভিস্যেমা।
ট্রেকার্স হাটে ডর্মিটরি ছাড়াও 4টে এটাচ্ড বাথরুম সহ কাঠের ঘর আছে। যেমন ঘরের অবস্থা, তেমনি বাথরুম, দুটো কাঠের তক্তাপোষ, তাও উচু-নিচু, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া কাঠের ফাঁক দিয়ে ঢুকে হাড় কাঁপিয়ে দেয়। খাবারের ব্যবস্থা বলতে ওখানের কিচেনে ডাল ভাত, নুডুলস আর চা। নীচে থেকে চাল, ডাল, মসলাপাতি, কেরোসিন, বাসনপত্র নিয়ে গেলে নিজেরাই কাঠের চুল্লিতে রান্না করে নেওয়া যায়। কিচেনে কাঠ কিনতে পাওয়া যায়। সমস্ত অব্যবস্থাপনা জুকু ভ্যালি তার সৌন্দর্য দিয়ে ভুলিয়ে দেবে।
ছবি- অর্ণব সরকার