‘উও দেখিয়ে, হমলোগো কা কালকা যানে কা রাস্তা' - গাইড নারায়ণের বাড়িয়ে দেওয়া আঙুলের দিকে চোখ কুঁচকে তাকাই! ধূ ধূ বরফের ঢালের মধ্যে রাস্তা কোথায়? এ কি ধরনের রসিকতা??
সবেমাত্র মিনিট পনেরো হল হাঁচোড়-পাঁচোড় করে আমরা পাঁচজন, নারায়ণের সাথে পাথরনাচুনিয়া থেকে কৈলু বিনায়ক টপে উঠেছি। শ্বাস স্বাভাবিক হয়নি, সামনে ফুটে ওঠা দৃশ্যের বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরোতেই পারি নি, এর মধ্যে আবার কালকের সামিটের রাস্তা! বাঁ দিকে চোখ তুললে, বাঙালীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল শৃঙ্গ নন্দাঘুন্টি, ডানদিকে মৃগথুনী, মাইকতোলি। আর সামনের সম্পূর্ণ দৃশ্যপট জুড়ে বিশালাকৃতি ত্রিশূল। তারই কোল ঘেঁষে একদিকে ইঙ্গিত করে আছে নারায়ণের আঙুল।
ওই বাঁহাতের উপরে ত্রিশূলের কোলে রূপকুন্ডের খাঁজ
নন্দাঘুন্টির সামনে আমরা
নিচের উপত্যকা থেকে হু হু করে উঠে আসছে সাদা মেঘের দল, অল্পক্ষণের মধ্যেই ঢাকা পড়ে যাবে চারপাশ। তড়িঘড়ি শাশ্বতর ক্যামেরার টেলিলেন্সে চোখ রাখতেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আর অজান্তেই নিজের শিরদাঁড়া বরাবর এক হিমশীতল অনুভূতি গড়িয়ে গেল। উপরে নিচে দুই ৪৫ ডিগ্ৰি বরফের ঢালের মাঝখান চিরে সরু ফিতের মত যেটা পড়ে আছে, সেটাই কালকের রাস্তা! পিঁপড়ের আকৃতির কিছু নড়াচড়া দেখে বোধ হয় আজকের যাত্রীরা এখনও ঐ রাস্তায় আছে। নারায়ণ তখনও উৎসাহ ভরে দেখিয়ে চলেছে আরো এগিয়ে কেমন করে ঐ রাস্তা ছেড়ে ৭০ ডিগ্ৰি খাড়াই এক বরফের ঢাল বেয়ে উঠলেই ওপাশে রূপকুন্ড।
রহস্যময়ী রূপকুন্ড বা skeleton lake। এই হাই অল্টিটিউড ট্রেকের চিরকালীন আকর্ষণ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রহস্যে মোড়া রূপকথা ঘিরে। ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এক গ্লেসিয়াল লেক, তার চারপাশে পড়ে থাকা হাজার বছরের পুরনো নরকংকালের অবশিষ্ট, পৌরাণিক মতে শিবের ত্রিশূল-সৃষ্ট দেবী পার্বতীর স্নানের হ্রদ, অথবা উপকথা অনুসারে দেবীর শাপে পাথর হয়ে যাওয়া সপার্ষদ রাজা, এর যে কোনো একটি কারণই আমাদের পাহাড়-প্রেম কে জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট হত। আমরা পাঁচ বন্ধু প্রায় ছ'বছর ধরে এই ট্রেক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এ পথে এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে চলা ইন্ডিয়াহাইকস্এর ২৭ জনের এই দলটি পুরো ছন্নছাড়া। বেশির ভাগ যেমন একদম আনকোরা ট্রেকার, তেমনি তীর্থযাত্রীও(!) বাদ নেই। স্বাভাবিক কারণেই দ্বিতীয় দিনের পর থেকে দলের সদস্য সংখ্যা কমতে আরম্ভ করেছে।
এই ধরনের ট্যুর অপারেটরদের যেটা লক্ষ্য থাকে, শেষ মুহূর্ত অবধি দল বাড়িয়ে যাও। বাড়তে বাড়তে ঊর্ধসীমা ২০ থেকে এখন ২৭। স্বাভাবিকভাবে কাঠগোদামের বাস থেকে শুরু করে বেসক্যাম্প লোহাজংএ থাকার জায়গা অবধি গাদাগাদি। ৮০০০ ফুট লোহাজং থেকে শুরু করে চতুর্থ দিনের সকালে আমরা ১৪৫০০ ফুট উচ্চতায় কৈলু বিনায়ক টপে দাঁড়িয়ে। ২ কিমি দূরে শেষ ক্যাম্প বগুয়াবাসা। সেখান থেকে রূপকুন্ড আনুমানিক ৪ কিমি। দলের আরো সক্ষম চার/পাঁচজন আমাদের আগেই বগুয়াবাসার দিকে এগিয়ে গেছে।
কৈলু বিনায়ক
আমরা প্রাণভরে এখান থেকে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করে, কৈলু বিনায়কের পূজো দিয়ে এগোলাম আবার। আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগের ঝকঝকে আকাশ এখন ঘন মেঘে ঢাকা। ক্যাম্পে পৌঁছনোর আগেই মিহি তুলোর মত বরফের গুঁড়ো উড়তে শুরু করলো। আমরা গতি বাড়ালাম।
আলি বুগিয়াল
ক্রমশ..