রূপকুন্ড : ফিরে দেখা (দ্বিতীয় ভাগ)

By : শান্তনু মিত্র | : 19 August, 2021
রূপকুন্ড : ফিরে দেখা (দ্বিতীয় ভাগ)

পঞ্চম দিন, সামিট তারপর

বগুয়াবাসা থেকে রূপকুন্ডের সেই ঢাল,তার মাঝ বরাবর ফিতের মত আমাদের পথ

বাড়ানো পা'টা নিজের দিকে টেনে নিয়ে দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে আমি নারায়ণ কে বললাম, এই পর্যন্তই, এখান থেকে আমি ফিরবো দলের স্বার্থে বোঝা হয়ে আরো এগোতে আমি রাজি নই রাতের আকাশে এখনও তারারা জেগে ইতস্তত চোখে পড়ছে গতিমান টর্চ, কারো মাথায়, কারো হাতে কাল একরাশ চিন্তা ভাবনা আলোচনার পর যখন আমরা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম, তখন দল আরো ভেঙে গেছে  পুণা থেকে আসা অনুজা'রা তিনজনের মধ্যে দু'জনের জ্বর বলে আর এগোতে চায় না ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে ঘন্টাখানেকের মধ্যে প্রস্তুতি সেরে আমরা বাকি দল নেমে পড়েছি সর্দার সিং আর নারায়ণের সঙ্গে হুনিয়াথর ক্যাম্প থেকে এক কিমি পথ আসতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি বোল্ডার জোন, সরু রাস্তা, বাঁ পাশে খাদ, তাও আধঘন্টায় পেরিয়ে এসেছি তারপরেই সামনে শুরু এই অন্তহীন বরফের পথ শক্ত, পিছল বরফে আইস এক্স দিয়ে পথ কাটতে কাটতে এগোচ্ছে সর্দার তার পিছন পিছন দলের সক্ষম ট্রেকাররা এমন কি তারাও টালমাটাল খাচ্ছে আমাদের শাশ্বত, সুমন, শরদিন্দুরা মোটামুটি সামলাচ্ছে, ভোলা একরকম আমি বরফে প্রথম পা বাড়িয়েই বুঝতে পেরেছি আমার জুতোজোড়া একেবারেই অনুপযুক্ত পথের জন্য তাই বেঁকে বসেছি আর যাবোনা বলে আমাদের পাঁচজনের মধ্যে শারীরিক দিক দিয়ে আমি সবথেকে কমজোরী, বয়সটাও অর্ধশতক পার হয়েছে শুধুমাত্র অসম্ভব মনের জোর, আর তীব্র ভালোবাসায় এতোটা পথ এগিয়েছি এখন এখান থেকে ফিরে যেতে হলেও আমার মনে কোনো গ্লানি থাকবে না ট্রেক আমার কাছে একটা গন্তব্য জয় নয় প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্ত এখানে আমার কাছে দেবতা দর্শনের সমান প্রথম দিন লোহাজং থেকে দিদিনার পথে নামার সময় যে আকাশ, যে হাওয়া, যে সমস্ত মানুষ আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল, তাদের ভিতর দিয়েই আমার সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে আলী বুগিয়ালের অপরূপ সৌন্দর্য, বৃষ্টি ধোওয়া বেদিনী বুগিয়াল থেকে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত ত্রিশূল, ঘোড়ালোটানিতে ভয়ংকর শিলাবৃষ্টির জেরে তিন ঘন্টা আটকে থাকা, আর এই অসম্ভব ছন্নছাড়া দলটির প্রত্যেকটি সদস্য, এই সবের মধ্যে দিয়েই আমার ট্রেক সার্থক হয়ে গেছে বাকি যা পাওয়া, সেটা উপরি নারায়ণ সহজ, সরল গ্ৰামের মানুষ এত জটিল মনস্তত্বের ধার ধারে না আমাকে পিছিয়ে আসতে দেখে জোরের সঙ্গে জানালো যে আমাকে রূপকুন্ড অবধি নিয়ে যাবেই! এই ভালোবাসার জোরের কাছে হার স্বীকার করতেই হয় আর আমাদের ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতাদের করা প্রতিশ্রুতি নয়!! পাহাড়ি মানুষের জবান

রূপকুন্ডের_আগে_বিপদসংকুল_ঢাল

রূপকুন্ডের আগে বিপদসংকুল ঢাল

শুরু হল এরপর সেই অসম মরণপণ লড়াই পা টিপে টিপে, কখনও আছাড় খেয়ে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে আমার উপর দিকে উঠে চলা আর নারায়ণ, কখনও পিছন থেকে ঠেকনা দিয়ে, সামনে থেকে হাত ধরে টেনে, অথবা খাদের দিকে পুরো শরীর দিয়ে ঢালের মত আড়াল করে আমায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া! মৃত্যুভয় কে যেমন প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছি, ঈশ্বরের উপস্থিতিও তেমনি প্রত্যক্ষ করেছি রূপকুন্ডের ছবি নয়, মনের মধ্যে শুধুই সেই প্রিয় মানুষগুলোর মুখ ভাসছে, যাদেরকে ছেড়ে পথে এসেছি! বুকের মাঝে কাঁপুনি যেমন জাগছে, চোখ জুড়িয়ে যাওয়া এই ভয়ংকর সৌন্দর্য তেমনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে ঘন্টাখানেক পরে একটু যুদ্ধবিরতি, দম নেওয়ার মত একটু ফাঁক, চোখ তুলে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করার মত একটু নিশ্চিন্দি আর তার সঙ্গে অফুরন্ত ফোটোসেশন! রূপকুন্ডের উপরে জিয়ুনার কলের মাথায় সূর্যের প্রথম টিকা, অনবদ্য দূরে, উল্টোদিকের নীলকণ্ঠ, চৌখাম্বা উদ্ভাসিত ভোরের মায়াবী আলোয় নিচে, পার হয়ে আসা বিস্তীর্ণ বরফের প্রান্তরে ইতস্তত পিঁপড়ের মতো নড়াচড়া করা আমাদের দলের বাকিরা 

শেষ চড়াই

এইসব ছেড়ে বাস্তবের দিকে চোখ ফেরাতেই হয়, আর তখনই বুকের ধুকপুকুনি বাড়তে থাকে সামনে পরপর সেই ৭০ ডিগ্ৰি কোণের ঢালদুটো সর্দার একটু রেইকি করে এসে আমাদের তাড়া লাগালো রওয়ানা দিলাম আমাদের দলটা প্রথম ঢালের নিচে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখে নারায়ণ যা বোঝার বুঝে নিলো আমার হাতটা কঠিন মুঠোয় চেপে বললো 'ছোড়না নহী, কিসী ভী হালৎ মে, অউর রুকনা নহী' তারপর এক হ্যাঁচকা টান মেরে দৌড় দিল উপর দিকে! আমি কিছু বোঝার আগেই দেখলাম নারায়ণের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে আমি উপরে উঠছি ধকধক ধকধক শব্দে হার্ট যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে নিজের মুখের চেহারা তো দেখতে পাচ্ছি না! কোনরকমে মুখ দিয়ে বেরোলো, 'রুকো, রুকো, নহীঁ তো মর জাউঙ্গা' নারায়ণের দয়া হল সে দৌড় থামালো হ্যা হ্যা করে হাপরের মত শ্বাস ফেলতে ফেলতে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ঢালটার অর্ধেকের বেশি আমরা উঠে এসেছি! বাকি ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফেরার আগেই নারায়ণের দ্বিতীয় হ্যাঁচকা দৌড়, আর মিনিট খানেকের ভিতরেই আমরা ঢালের উপরে! আস্তে আস্তে দম ফেরার সাথে সাথে ঠিক কি ম্যাজিকটা ঘটলো সেই উপলব্ধিটা মাথার মধ্যে ঢুকছিলো সামনের ঢালটা আর সরাসরি নয়, বাঁদিক দিয়ে ঘুরে বড় ইউ টার্ন নিয়ে আমরা পার হলাম আর তার পরেই সেই স্বপ্নের মুখোমুখি যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তার তিন/চারশো ফুট নিচে রহস্যময়ী রূপকুন্ড, skeleton lake ডানদিকে কয়েকশো ফুট উপরে জিয়ুনার কলের বরফে পিছলে পড়ছে ভোরের সোনালী ঝিলিক এক অপার্থিব স্বর্গীয় অনুভূতির সাক্ষী আমরা

(ক্রমশ)

 

লেখক পরিচিতি

শান্তনু মিত্র
শান্তনু মিত্র
একটা পাহাড় কেনার স্বপ্ন দেখার সাহস কখনও হয়নি, তবে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা নিজের বাড়ির ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিলো ১০ বছর বয়সে মুসৌরি দেখে। অবিশ্বাস্য ভাবে সে স্বপ্ন সত্যিও হয়েছিল কর্মজীবনের প্রথমদিকে। কুমায়ুনের সেই দিনগুলি থেকে পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা আরো পরিণত হয়। সম্মান করতে শিখি পাহাড়ী মানুষদের সরল কিন্তু কঠিন জীবনযাত্রাকে। জাতি, কর্ম, ধর্ম সবকিছু ভুলিয়ে পাহাড় আজও জীবনের পরম মন্ত্র কে জপ করতে শেখায়, মাথা নিচু করে চলার মন্ত্র। চরৈবেতি।

জুকু উপত্যকা

10 April, 2021 | : অপরেশ সরকার

রূপকুন্ড : ফিরে দেখা

05 August, 2021 | : শান্তনু মিত্র

রূপকুন্ড:ফিরে দেখা (তৃতীয় ভাগ)

29 December, 2021 | : শান্তনু মিত্র

রূপকুন্ড : ফিরে দেখা

05 August, 2021 | : শান্তনু মিত্র