পঞ্চম দিন, সামিট ও তারপর ২
এক অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি নিচে ঐ প্রায় জমে যাওয়া ছোট্ট হ্রদটির দিকে। কত রূপকথা, উপকথা, কল্পনা, গবেষণা এই প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে ঘিরে। শিবঠাকুরের তৈরি পার্বতীর স্নানের জন্য এই জলাধার, যেখানে নিজের রূপ দেখে দেবী মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন! লেকের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তিনশোরও বেশি মানুষের হাড়, কখনও বা ছেঁড়া কাপড়-জামার অংশ সহ, ইত্যাদি থেকে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন গল্প। দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধের কাহিনী, অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার কোন তীর্থযাত্রীর দল। বা নন্দাদেবীর রোষে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই উদ্ধত রাজা ও তার দলবল! কোনো গল্পটাই শেষমেশ ধোপে টেঁকে না। অবশেষে বিজ্ঞানের হাত ধরে যে সত্য উঠে এলো তা হল, এক ভিন্ন প্রদেশের তীর্থযাত্রীরা, সঙ্গে যাদের মেয়ে ও শিশুরাও ছিলো, আর স্থানীয় মালবাহকের দল, এক বিধ্বংসী শিলাঝড়ের সামনে এই দুর্গম আশ্রয়হীন প্রান্তরে ভয়াবহ মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। আজ এখানে পৌঁছতে পারার বিস্ময়কর ভালোলাগার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে এসব চিন্তা ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রায় তিন ঘন্টার দুরন্ত চেষ্টায় আমাদের ১৯ জন এই শেষ লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে সবাই। কেউ কেউ বরফে গ্লিসেডিং করে নেমে যাচ্ছে রূপকুন্ডের পাশে, কেউ গড়াগড়ি দিচ্ছে বরফে, হাসছে, কাঁদছে! কেউ আবার মুগ্ধ আকর্ষণে তাকিয়ে আছে জিয়ানুর কলের দিকে, পা বাড়ালেই হয়! সর্দার রা বারবার মানা করছে, বরফের গভীরতা বিপজ্জনক আজ ওদের মতে। আর চলছে মুহূর্মুহু ক্যামেরার শাটার টেপা। নিজেদের স্মৃতিটুকু ধরে রাখা যাবে, তা বাদে বাকি এই অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যামেরা তে ধরা অসম্ভব। আর আমার কি অবস্থা! এই বিরাটত্বের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরে আমি সম্পূর্ণ মূক, স্তব্ধ হয়ে গেছি। একদিকে নিজের ক্ষুদ্রতাকে উপলব্ধি করা, অন্যদিকে এক বিশাল মহিমার কাছে এসে পৌঁছতে পারার অবর্ণনীয় আনন্দ। পাহাড়ের রীতি অনুযায়ী স্থানীয় দেবতা নন্দাদেবীর পূজো দিলাম আমরা ধূপ জ্বালিয়ে এক ছোট্ট অস্থায়ী পাথরের মন্দিরের সামনে। বিস্ময় ফুরোনো তখনও বাকি। গোটা দলটা যখন সামিট করার আনন্দে মত্ত, তখন আমাদের সাপোর্ট স্টাফদের তিনটি ছেলে এসে পৌঁছলো। হাতের ক্যাসারোলে আলুর পরোটা, আচার!! আমরা ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে এই সব বানিয়ে তারা বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছে এখানে, কারো কারো পায়ে আবার হাওয়াই চপ্পল! রূপকুন্ড কে সাক্ষী রেখে আলুর পরোটা দিয়ে প্রাতরাশ! মরার আগে অবধি এ স্মৃতি ভোলা যাবে না।
নারায়ণ আর সর্দার ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এতগুলো পাগল কে একসাথে করা কি সহজ কথা! শেষমেশ সাড়ে আটটা নাগাদ এই অনিন্দ্য সুন্দর পটভূমি ছেড়ে আমরা নামতে শুরু করলাম। আর তখনই বুঝলাম কেন অভিজ্ঞ গাইডরা বারবার তাড়া দিচ্ছিল! রোদ একটু বাড়তেই উপরের নরম বরফ গলতে আরম্ভ করেছে, দুর্গম পথ পিছল হয়ে আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। আসার সময় যে অ্যাভালান্স জোন গুলো পেরিয়ে এসেছিলাম, সেগুলো এখন আরো বিপজ্জনক। আমার হাত-পা আরো ঠান্ডা হয়ে গেল। অনুপযুক্ত জুতোজোড়ার জন্য India hikes এবং নিজেকে জুতোতেই ইচ্ছে করছে। নারায়ণ আক্ষরিক অর্থেই আমার ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছে। সামনেই সেই ৭০ ডিগ্ৰি ঢাল। বুকের সাহসের থলিটা ফুলিয়ে নিয়ে সবে ঐ পথে পা বাড়াতে যাব, হঠাৎ সমবেত স্বরে একটা চিৎকার ভেসে এলো। এ পরিবেশে এই চিৎকারের বাংলা তে একটাই আক্ষরিক অনুবাদ হয়, 'গেলো, গেলো'! আমাদের দৃষ্টিপথের বাঁদিক থেকে একটা বসা মানুষের শরীর বিদ্যুতের গতি তে ঢাল বেয়ে ডানদিকে নিচে নেমে গেল। আতঙ্কে আমরা বাকিরা নড়বার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি, রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছি সেই মারাত্মক ধাক্কার শব্দটার জন্য। তীব্র টেনশনে বাতাস জমে গেছে, যেন ছুরি দিয়ে কাটা যাবে। হঠাৎই সবাইকে চমকে দিয়ে সমবেত হাততালি আর উল্লাসের আওয়াজ, 'বঁচ গয়া, বঁচ গয়া'! পরে জেনেছিলাম, সর্দার ঢালের নিচে ছিলো। অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আইস এক্স টা বরফে গেঁথে ও পিছলে যাওয়া শরীরের জ্যাকেট টেনে ধরে গতিটাকে একদম কমিয়ে দেয়। বাকিটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। মহারাষ্ট্রের ছ'ফুটের উপর লম্বা অর্জুন, ভয় পেয়ে ঢালের মুখে বসে পড়তেই এই বিপত্তি! এই আপাত দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখে ঢালের উপরের বাকি দলটার কিন্তু তখন মন পুরোপুরি নড়বড়ে। কেউ আর একপাও এগোচ্ছে না! লাইনের শুরুতে দক্ষিন ভারতীয় রাজারাম বসেই পড়লো, এবারে পুরো ট্র্যাফিক জ্যাম! বাধ্য হয়ে নারায়ণ আমাকে টানতে টানতে বরফ কেটে একটা নতুন পথ বানিয়ে আমি সহ বাকিদের ঢাল টা নেমে আসতে সাহায্য করলো। ঢালের নিচে পৌঁছে দেখি অর্জুনের হাতে গরম চা, কিন্তু তাতেও তার শরীরের কাঁপুনি থামছে না। এই ভয়ংকর পথে উপর ওঠার চাইতেও নিচে নামা যে আরো কত বেশি শক্ত, তা আমরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছি। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে বুকের সাহসের থলিটাকে একটু ফুলিয়ে নিয়ে আতঙ্ক আর আনন্দের মাঝে দোল খেতে খেতে এরপর নেমে চলা। ফেরার পথে আমি আছাড় খেয়েছি অনেকবার, কিন্তু তখন মনে অসম্ভব জেদ, এই স্মৃতি নিয়ে বাড়ির লোকের কাছে ফিরতেই হবে আমায়!
নামার পথে দম নিতে যখনই থেমেছি, পিছনের দিকে চোখ চলে গেছে। অন্যদের কথা জানি না, ঐ অপার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েও আমার মনে হয়েছে কি করে এই রাস্তা পার হয়ে আমি পৌঁছলাম ওখানে! এক এক করে অ্যাভালান্স জোন গুলো পার হয়ে সর্দারদের মুখে হাসি ফুটলো। খাবার জল শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, মুখের ভিতরটা শিরিষ কাগজের মত শুকনো। ভয়ে, উত্তেজনায়, পরিশ্রমে ভিতর অবধি ভিজে একসা। চার প্রস্থ জামা-কাপড়ের একদম ভিতরের টি শার্টটা নিংড়োলে এক মগ জল বেরোবে নির্ঘাত! পথে বরফ গলা একটা জলের ধারা দেখে সেখানেই মুখ লাগিয়ে আকন্ঠ তৃষ্ণা মেটালাম সবাই। হুনিয়াথরের ক্যাম্পে পৌঁছে তাড়াতাড়ি নাকে মুখে গুঁজে আবার পথে নেমে পড়া। সময় যে নেই, দুপুর বারোটা বাজে প্রায়, এখনও ১৫ কিমি হেঁটে বেদিনী ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে। অনুজা রা অপেক্ষা করছিলো। আমাদের ওষুধে সমতা ও পল্লবী ভালোই আছে। সবাই একসঙ্গেই বেরোলাম ফেরার পথে।
কৈলু বিনায়কের মন্দির চত্বর থেকে শেষবারের মত ফিরে দু'চোখ ভরে দেখলাম ত্রিশূল চূড়োর কোলে লুকোনো রহস্যময়ী রূপকুন্ডের দিকে। ভাবতেও অবাক লাগে, এই কঠিন পথে জিয়ুনার কল পার হয় আরো ১২ কিমি দূরের হোমকুন্ড তে বারো বছর অন্তর সেপ্টেম্বর মাসে বড়া নন্দাজাত পূজোয় জড়ো হয় গ্ৰামবাসীরা!
এর পরের খাড়াইটুকু নামতে নামতে শরদিন্দু আর আমার মুখ দিয়ে একই মনের ভাব বেরিয়ে এলো, 'কৌন সা পাগল কুত্তা নে কাটা থা হামলোগো কো', যে এই রাস্তা চব্বিশ ঘন্টায় আমরা দ্বিতীয় বার পার হচ্ছি!!
সত্যি, কি পাই আমরা এরকম সব পিছুটান কেটে পাগলের মত দৌড়ে পথে বেরিয়ে পড়তে? প্রকৃতির সৌন্দর্য? ঈশ্বরের স্পর্শ? ট্রেক জয় করার শ্লাঘা? অথবা কেবল দৈনন্দিন সাংসারিক বিরক্তি থেকে পালানো?! মনের ভিতর একরাশ প্রশ্ন নিয়ে যন্ত্রের মত এগিয়ে চলি বেদিনী বুগিয়ালের দিকে। আস্তে আস্তে দেখি কখন যেন একলা হয়ে গেছি চলার পথে, সঙ্গের সাথীরা কেউ এগিয়ে গেছে, কেউ বা পিছিয়ে পড়েছে! চারপাশের অনন্ত নিস্তব্ধতার মাঝেই খুঁজে পাই উত্তর। মানুষ কে জানার, নিজেকে জানার, এর থেকে বড় সুযোগ বা অবকাশ আর কোথায় পাবো!
গত পাঁচ/ছ বছর ধরে ঘুমে-জাগরণে যে রহস্যময়ী রূপকুন্ডের পথ স্বপ্ন দেখাত বারবার, আজ সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফিরে চলেছি। ফিরে চলেছি তাদের কাছে, এই স্বপ্নের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যাদের আত্মত্যাগ সবথেকে বেশি। আমার কোনো ট্রেকেই সঙ্গে না থেকেও, আমার বউ, মেয়ে আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গী। ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাইনা।
ট্রেকের গল্প, উত্তেজনা ফুরিয়ে গেছে। এখন শুধু মনের জোরে ক্লান্ত পা দুটোকে টানতে টানতে দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া। জানা ছিলো না, সেখানেও অপেক্ষা করে আছে এক মধুর বিস্ময়। রাত চারটেতে যে অভিযান শুরু করেছিলাম, ক্লান্তি অবসাদে মাখামাখি হয়ে বিকেল চারটের সময় যখন আমি বেদিনী ক্যাম্পে এসে ঢুকলাম, হাততালি আর উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিল আমার সতীর্থরা সবাই। না, প্রায় সবাই! এই দলটি তে আমি অন্যতম বয়ঃজ্যেষ্ঠ। যারা অনেক আগেই ট্রেকের পথ ছেড়েছিল, যেভাবে তারাও আমায় অভ্যর্থনা জানালো, যেন আমার এই সার্থকতা তাদেরও নিজস্ব জয়। মৃত্যুভয়ের মুখ থেকে সফলতার এই শিখরে ফেরার আনন্দ-উজ্জ্বল মুহূর্তের সাক্ষী হিসেবে আমার অভিব্যক্তি ধরা পড়লো শাশ্বতর ক্যামেরায়। আর আমার অন্তর চির কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে রইলো এক সার্থকনামা মানুষের কাছে; নারায়ণ সত্যিই ঈশ্বরের স্বরূপ আমার জীবনে। জানি আজ শরীর ক্লান্ত থাকবে অসম্ভব, কিন্তু মন ছটফট করবে এক তীব্র উন্মাদনায়। আর একটু পরে সকলে মাতবে ট্রেকের শেষ রাতের ক্যাম্প-ফায়ারে। তারপর কাল আলী বুগিয়ালের দিকে না গিয়ে অন্য পথে আমরা নেমে যাব গেহরোলি পাতাল হয়ে ওয়ান গ্ৰামের দিকে। সেখান থেকে আরো আরো দ্রুত গতিতে সভ্যতার যন্ত্রণাময় বন্ধনের মাঝে। ঐ বাঁধনেই আবার জড়িয়ে থাকবো ততদিন, যতদিন না সেই পাগলা কুকুরটা আবার কামড়ায়! আসি, আবার দেখা হবে নিশ্চই।
বিঃ দ্রঃ - সরকারি নিষেধাজ্ঞায় বুগিয়ালে ক্যাম্পিং বন্ধ হওয়ার ফলে লেখক বর্ণিত রূপকুন্ডের এই রাস্তা বর্তমানে খোলা নেই। এই পথের একটি ম্যাপ এখানে সংযোজিত হল।